গোলাম মোহাম্মদ কাদের | বাংলাদেশ প্রতিদিন । প্রকাশ : মঙ্গলবার, ১০ জুলাই, ২০১৮
জাতীয় পার্টির রাজনীতি নিয়ে মানুষের মধ্যে কিছুটা বিভ্রান্তি লক্ষ্য করা যায়। অনেকেই মনে করেন, জাতীয় পার্টির কর্মকাণ্ডে সামঞ্জস্যতার অভাব আছে। তাদের মতে এ দলের রাজনীতি অস্বচ্ছ। প্রায়ই এতে পরস্পরবিরোধী আদর্শগত অবস্থানের আভাস লক্ষ্য করা যায়।
জাতীয় পার্টির রাজনীতি নিয়ে মানুষের মধ্যে কিছুটা বিভ্রান্তি লক্ষ্য করা যায়। অনেকেই মনে করেন, জাতীয় পার্টির কর্মকাণ্ডে সামঞ্জস্যতার অভাব আছে। তাদের মতে এ দলের রাজনীতি অস্বচ্ছ। প্রায়ই এতে পরস্পরবিরোধী আদর্শগত অবস্থানের আভাস লক্ষ্য করা যায়।

একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন অত্যাসন্ন। এ নির্বাচন নিয়ে চূড়ান্ত প্রস্তুতির এখনই সময়। এ বিষয়ে জাতীয় পার্টির চিন্তা-ভাবনা কী বা কোন পথে এ দলটি অগ্রসর হবে, সে সম্পর্কে জনমনে কৌতূহল আছে। কেননা এই তৃতীয় বৃহত্তম দলটির ভূমিকা দেশের সার্বিক রাজনীতিতে একটি বড় ধরনের প্রভাব ফেলবে, এটা প্রায় নিশ্চিতভাবে বলা যায়।

নির্বাচনে সব দল অংশগ্রহণ করবে কিনা বিষয়টি এখনো নিশ্চিত নয়। বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের (বিএনপি) পক্ষ থেকে সহায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন, সংসদ ভেঙে দেওয়া, নির্বাচন কমিশন পুনর্গঠন ইত্যাদি বেশ কয়েকটি দাবি দেওয়া হয়েছে। বলা হচ্ছে, ওই সব দাবি পূরণ হলেই তারা নির্বাচনে আসবে নতুবা নয়।

এদিকে আওয়ামী লীগ সরকারের পক্ষ থেকে বর্তমান সংবিধানের অধীনে অর্থাৎ সরকার ও সংসদ বহাল রেখে ও বর্তমান নির্বাচন কমিশনের মাধ্যমে নির্বাচন করা হবে, এ অবস্থানে তারা অনড়। বলা হচ্ছে, বিএনপি বা অন্য কোনো দল নির্বাচনে না এলেও নির্বাচন সময়মতো হবে।

সেই পরিপ্রেক্ষিতে দলের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, দুই অবস্থানের কথা মাথায় রেখেই জাতীয় পার্টি প্রস্তুতি নিচ্ছে। গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক দলসমূহ অংশগ্রহণ করলে জাতীয় পার্টি কোনো একটি জোটের অংশ হিসেবে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করবে। আর যদি কোনো বিশেষ রাজনৈতিক দল বা জোট যারা এখন পর্যন্ত জাতীয় রাজনীতিতে গুরুত্ব বহন করে তারা (যেমন বিএনপি বা ২০-দলীয় জোট) নির্বাচন বর্জন করে সে ক্ষেত্রে জাতীয় পার্টি এককভাবে (তার জোটভুক্ত দলগুলোকে সঙ্গে নিয়ে) ৩০০ আসনের সবকটিতে ক্ষমতাসীন দল বা জোটের বিরুদ্ধে প্রার্থী দেবে। জনগণের অধিকাংশের ধারণা, জোটভুক্তভাবে নির্বাচন হলে বিরাজমান পরিস্থিতিতে জাতীয় পার্টি মহাজোটের অংশ হিসেবে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন জোটের সঙ্গে ঐক্যবদ্ধ হবে।

উপরোক্ত পরিপ্রেক্ষিতে জাতীয় পার্টিকে দুই ধরনের সাংঘর্ষিক অবস্থানের সম্মুখীন হতে হবে বলে অনেকের কাছে প্রতীয়মান হচ্ছে। প্রথমটি সাংগঠনিক, অন্যটি আদর্শিক।

সাংগঠনিক সমস্যাসমূহ নিম্নরূপ : মহাজোটের অংশ হিসেবে নির্বাচন করলে ৩০০ আসনের অধিকাংশতেই শরিক দলগুলোকে ছাড় দিতে হবে। সে আসনগুলোয় জাতীয় পার্টি প্রার্থী দিতে পারবে না। অনেক স্থানে শক্তিশালী প্রার্থী ও সাংগঠনিক কাঠামো তৈরি থাকার পরও নির্বাচনে নিজেদের প্রার্থী দিতে না পারার কারণে ওইসব স্থানে পরবর্তীতে দলীয় অবস্থান দুর্বল হওয়ার সম্ভাবনা থাকবে। যেসব স্থানে এমনিতে অবস্থান ততটা মজবুত নয়, সেসব এলাকায় পরবর্তীতে জাতীয় পার্টি ধরে রাখা কষ্টসাধ্য হতে পারে।

আবার সরকারি দল ও জোটের বিরুদ্ধে ৩০০ আসনে উপযুক্ত প্রার্থী দেওয়ার সক্ষমতা জাতীয় পার্টি ও সঙ্গের জোটের কতটুকু আছে তা অনেকের কাছে প্রশ্নবিদ্ধ। সে ক্ষেত্রেও উল্লেখযোগ্যসংখ্যক আসনে উপযুক্ত প্রার্থী ও প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক সাংগঠনিক অবস্থান না থাকার কারণে ফলাফলে দীনতা ও সে কারণে দলীয় ভাবমূর্তির অবনতি হওয়ার আশঙ্কা থাকে। পরিণতিতে অন্তত এসব স্থানে দলের অস্তিত্ব সংকট সৃষ্টি হতে পারে।

প্রথম ক্ষেত্রে জাতীয় পার্টির অনেক উপযুক্ত প্রার্থী ও শক্তিশালী সংগঠন বঞ্চনার শিকার হবে। দ্বিতীয় ক্ষেত্রে উপযুক্ত প্রার্থী ও শক্তিশালী সংগঠনের অভাবে অনেক আসনে ফলাফলে দীনতার আশঙ্কা। এ দুই ধরনের পরস্পরবিরোধী অবস্থানে উভয় ক্ষেত্রেই ভবিষ্যতে এ দল দুর্বলতর হওয়ার, এমনকি দলের অস্তিত্ব সংকটের আশঙ্কা থাকবে। এ পরিপ্রেক্ষিতে সার্বিক সাংগঠনিক পরিস্থিতি সামলানো দলের জন্য একটি বড় চ্যালেঞ্জ। এ সমস্যা মোকাবিলায় জাতীয় পার্টি কী করতে পারে তা জনগণের কাছে পরিষ্কার নয়। সে প্রসঙ্গে বলা যায়, সমাধানের সম্ভাব্য কৌশল হতে পারে নিম্নরূপ—

প্রথম অবস্থানের জন্য স্বাভাবিকভাবেই জোটের সঙ্গী দলগুলোর সঙ্গে দরকষাকষির মাধ্যমে যতটা সম্ভব অধিক আসন লাভের চেষ্টা চালানো। একই সঙ্গে সংসদ নির্বাচন ছাড়া অন্যান্য স্থানীয় সরকার নির্বাচনসমূহ জোটভুক্তভাবে করার ও সেক্ষেত্রে নিজ দলের উপযুক্ত বঞ্চিত প্রার্থীদের জন্য জোটের মনোনয়ন লাভের চেষ্টা চালানো। এ ছাড়াও জোট ক্ষমতায় গেলে, সরকারি বিভিন্ন লাভজনক পদে দলীয় নেতা-কর্মীদের নিয়োগের বিষয়ে চাপ অব্যাহত রাখা। সম্ভব হলে এসব মনোনয়নের পদ ও প্রার্থীদের তালিকা প্রস্তুত ও সে বিষয়ে জোট নেতাদের সম্মতি লাভের চেষ্টা চালানো ও অঙ্গীকার নিশ্চিত করা।

দ্বিতীয় অবস্থানের জন্য, নির্বাচন বর্জনকারী দলসমূহের উপযুক্ত প্রার্থীগণ ইচ্ছা প্রকাশ করলে তাদের দলে অন্তর্ভুক্তি ও নির্বাচনে মনোনয়নের ব্যবস্থা করা। একই সঙ্গে, এ ধরনের প্রচারণা চালানো যে, ১৯৯০ সালের পর অর্থাৎ জাতীয় পার্টি ক্ষমতা হারানোর পরবর্তীতে যে দুটি দল (আওয়ামী লীগ ও বিএনপি) পালাক্রমে দেশ পরিচালনার দায়িত্ব পালন করছে, তারা দেশের সাধারণ মানুষকে শান্তি ও নিরাপত্তা দিতে এবং তাদের প্রত্যাশা অনুযায়ী সমৃদ্ধি দিতে পারছে না। দেশের মানুষ পরিবর্তন চায়। জাতীয় পার্টি সে পরিবর্তন আনবে। অবশ্য নির্বাচন যাতে শান্তিপূর্ণ পরিবেশে সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন হয় সে বিষয়টি এ ক্ষেত্রে জরুরি। সে জন্য জাতীয় পার্টিকে পূর্ণাঙ্গ সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিয়ে সর্বাত্মক প্রচেষ্টা চালিয়ে যেতে হবে।

আগেই বলা হয়েছে, জাতীয় পার্টি আগামী দিনে সিদ্ধান্ত গ্রহণের দুটি বিকল্প পথ খোলা রেখেছে, জোটবদ্ধ বা একক নির্বাচন। আদর্শগতভাবে এ দুটি পরস্পরবিরোধী অবস্থান বলে অনেকের কাছে প্রতীয়মান হতে পারে।

নির্বাচন প্রশ্নে মতামতের ভিত্তিতে দেশের জনগণ এখন স্পষ্টভাবে দুই ধারায় বিভক্ত বলে ধারণা করা হয়। একপক্ষ বর্তমান সরকারের ধারাবাহিকতা বজায় থাকুক চায়। অন্য পক্ষ সরকারের পরিবর্তন চায় ও নতুন আঙ্গিকে সরকার পরিচালিত হোক এ প্রত্যাশা করে। জোটবদ্ধ নির্বাচন ও সে ক্ষেত্রে মহাজোটে নির্বাচন করলে প্রথম পক্ষকে ধারণ করতে হবে। সরকারের বিরুদ্ধে এককভাবে সব আসনে প্রার্থী দিয়ে নির্বাচন করলে প্রথম পক্ষের প্রতিদ্বন্দ্বী দ্বিতীয় পক্ষের জনমতকে প্রতিনিধিত্ব করতে হবে। এটি আপাতদৃষ্টিতে সাংঘর্ষিক।

জাতীয় পার্টির নির্বাচনী প্রচারণার কৌশল সে ক্ষেত্রে হতে পারে, সুশাসন প্রতিষ্ঠা। মহাজোটের অংশীদার হিসেবে সুশাসনের পক্ষে কাজ করবে এ বার্তা প্রচার। সরকারবিরোধী একক নির্বাচনে (নিজস্ব জোটসহ), সুশাসন প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে নতুন আঙ্গিকে দেশ পরিচালনা করা হবে এ বিষয়টি নিয়ে অগ্রসর হওয়া।

জাতীয় পার্টি সুশাসন দিয়েছে অতীতে দেশ পরিচালনার ক্ষেত্রে। ভবিষ্যতেও সুশাসন দিতে পারবে সে সক্ষমতা আছে ও সে লক্ষ্য সামনে নিয়ে এগিয়ে যাবে, এ অঙ্গীকার উভয় ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য।

সুশাসন অর্থ আইনের শাসন ও সামাজিক ন্যায়বিচারভিত্তিক সমাজব্যবস্থার প্রবর্তন। কেবল এর মাধ্যমেই দেশে শান্তি, সমৃদ্ধি ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করা সম্ভব। জাতীয় পার্টির বর্তমান স্লোগান ‘শান্তির জন্য পরিবর্তন ও পরিবর্তনের জন্য জাতীয় পার্টি’, বিদ্যমান পরিস্থিতিতে দলের বর্তমান আপাত দ্বিমুখী অবস্থানের সামঞ্জস্যতা যুক্তিসংগতভাবে উপস্থাপন করে। এটি চলমান আঙ্গিকে জনগণের গ্রহণযোগ্যতা লাভে সহায়ক হতে পারে।

বর্তমান সার্বিক জাতীয় ও আন্তর্জাতিক রাজনৈতিক পরিস্থিতিকে অনেকে গভীর সমুদ্রে ঝড়ো আবহাওয়ার সৃষ্ট উত্তাল ঢেউয়ের সঙ্গে তুলনা করছেন। সে ক্ষেত্রে প্রাসঙ্গিক নানাবিধ কারণে জাতীয় পার্টিকে বলা যায় আকার ও উৎকর্ষতার সীমাবদ্ধতাসহ সমুদ্রে বিচরণশীল একটি জাহাজ। এ উত্তাল সমুদ্র পাড়ি দিয়ে গন্তব্যে পৌঁছাতে হবে জাতীয় পার্টিকে। যাত্রাপথে ক্ষণে ক্ষণে দিক পরিবর্তন ও ঢেউয়ের মাথায় ওঠা ও নিচে আছড়ে পড়া ছাড়া ভেসে থাকা কঠিন, সেভাবেই এগিয়ে যেতে হচ্ছে। এ কারণেই জাতীয় পার্টির কর্মকাণ্ড অনেকের কাছে অসামঞ্জস্য ও লক্ষ্যহীন বলে প্রতীয়মান হচ্ছে। বাস্তবতা হলো, এ দলের অস্তিত্ব ও রাজনীতি টিকিয়ে রাখার প্রয়াসেই উপর-নিচ, ডান-বাম বিচরণের সার্বক্ষণিক বৈচিত্র্য জরুরি। বিরাজমান পরিস্থিতিতে নির্বাচন বিষয়ে জাতীয় পার্টির কর্মকাণ্ড ও কৌশল নিয়ে যে বিভ্রান্তি আশা করি উপরোক্ত আলোচনায় তার অধিকাংশ দূরীভূত হবে। উপসংহারে এটা বলা যায়, জাতীয় পার্টির কর্মকৌশল কখনো কখনো বিভ্রান্তিমূলক মনে হলেও বা তাতে স্বচ্ছতার ঘাটতি থাকলেও তা সবসময় অযৌক্তিক বা অসংগতিপূর্ণ নয়।

লেখক : সাবেক মন্ত্রী ও কো-চেয়ারম্যান, জাতীয় পার্টি।