গোলাম মোহাম্মদ কাদের

বাংলাদেশ প্রতিদিন ।প্রকাশ : সোমবার, ২ এপ্রিল, ২০১৮

বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতিকে এখনো অনিশ্চিত বলা যায়। জাতীয় সংসদ নির্বাচন ২০১৮ সালের শেষ নাগাদ অথবা ২০১৯-এর শুরুতেই হওয়ার কথা। রাজনৈতিক দলগুলো প্রাথমিক প্রস্তুতিতে ব্যস্ত। রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মধ্যে এ নির্বাচন নিয়ে প্রচুর আলাপ-আলোচনা হচ্ছে।

ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ চায় বর্তমান সংবিধানে যে বিধান আছে, সে অনুযায়ী নির্বাচন হোক। অর্থাৎ সরকার প্রধান, সরকার ও সংসদ বহাল রেখে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে—এটা তাদের কাম্য। ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি দশম সংসদ নির্বাচন হয়েছিল এভাবেই। সে নির্বাচন সরকারি দলের প্রধান প্রতিপক্ষ বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি) ও তাদের শরিক দলসহ অন্য কিছু দল বর্জন করেছিল। বিএনপি ও শরিক দলসমূহ নবম সংসদে সংবিধান সংশোধন করে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিল করার বিপক্ষে ছিল। তারা সরকার ও সংসদ বহাল রেখে নির্বাচনের বিধানকে মেনে নিতে অস্বীকার করে। তারা নির্বাচনকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা পুনর্বহালের দাবি করেছিল। সে দাবিতে তারা এখন আর পুরোপুরি অনড় নয়। তবে, বর্তমান ব্যবস্থার বিকল্প হিসেবে নির্বাচনকালীন সহায়ক সরকার গঠন না হলে তারা এবারও নির্বাচন বর্জনের ও আন্দোলনের মাধ্যমে নির্বাচন ঠেকানোর হুমকি দিয়েছে। নির্বাচনকালীন সহায়ক সরকারের রূপরেখা বিএনপি বা ওই জোট থেকে এখনো জানানো হয়নি। ফলে, সার্বিক পরিস্থিতি বিবেচনায় অবাধ, সুষ্ঠু ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন সম্ভব হবে কিনা এ বিষয়ে সন্দেহের যথেষ্ট অবকাশ থেকেই যাচ্ছে।

বর্তমান সরকারের পক্ষে বলার মতো শক্তিশালী যুক্তিগুলো হলো—(১) উপর্যুপরি উচ্চ অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির হার ধরে রাখা, (২) মাথাপিছু আয় উল্লেখযোগ্য বৃদ্ধি, (৩) সামাজিক উন্নয়ন খাতের সূচকে অগ্রগতি, (৪) সহস্রাব্দ উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রার প্রায় সবগুলো অর্জন ও (৫) দৃশ্যমান অবকাঠামোগত উন্নয়ন। বর্তমান সরকারের দুর্বলতা হিসেবে অভিযোগ শোনা যায়, সার্বিক সুশাসনের ঘাটতি; (১) দুর্নীতির ব্যাপকতা, (২) দমন-পীড়ন নীতি ও (৩) ব্যাপক অব্যবস্থাপনার কথা।

সরকারের পক্ষে দাবিগুলোর বিরুদ্ধে প্রতিপক্ষের বক্তব্য ভিন্নতর। তাদের ভাষায়, উচ্চ অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির ঘোষণা, সাধারণ মানুষের চোখে একটি অঙ্কের সংখ্যা, এর বেশি কিছু নয়। তারা দেখতে চায় এর ফলে তাদের জীবন ব্যবস্থায় কী কী উন্নয়ন যোগ হলো। সাধারণভাবে উচ্চহারে প্রবৃদ্ধি নতুন নতুন চাকরির সুযোগ সৃষ্টি করার কথা। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত হলেও সত্য, বাংলাদেশ এর ব্যতিক্রম। সরকারি পরিসংখ্যান অনুযায়ী বার্ষিক কর্মসংস্থান সৃষ্টির সুযোগ ক্রমান্বয়ে নিম্নগামী।

অঙ্কের হিসাবে গড়ে মাথাপিছু আয় যথেষ্ট বৃদ্ধি হলেও প্রকৃত মাথাপিছু আয় বেড়েছে খুব অল্পসংখ্যক মানুষের। তবে তাদের ক্ষেত্রে ঘটছে এক একজনের বিশাল অঙ্কের বৃদ্ধি। দেশের বেশির ভাগ মানুষ ব্যক্তিগত পর্যায়ে বাড়তি আয়ের স্বাদ তেমন একটা পায়নি। সম্পদ বণ্টনের অসমতার সূচকে বাংলাদেশ উঁচু স্থানে ও প্রতি বছর এ সূচক অনুযায়ী অসমতা বৃদ্ধি পাচ্ছে।

বিভিন্ন খাতে সামাজিক উন্নয়ন সূচকের অগ্রযাত্রা সম্পর্কে সরকারবিরোধী পক্ষের মত হলো, এ অর্জন এককভাবে বর্তমান সরকারের নয়। বহু আগে থেকে এ অগ্রগতি চলমান ও এসব ক্ষেত্রে পূর্ববর্তী অন্য সরকারগুলোর অবদান অস্বীকার করা যায় না। তা ছাড়া, এ উন্নয়নে বেসরকারি সামাজিক উন্নয়ন প্রতিষ্ঠান বা এনজিওগুলোর ভূমিকাও যথেষ্ট গুরুত্ব বহন করে। অবকাঠামোগত উন্নয়ন ও এ সংক্রান্ত বৃহৎ প্রকল্পসমূহের বিষয়ে বিরোধী পক্ষের বক্তব্য, ওগুলো অব্যবস্থাপনা ও দুর্নীতির আখড়া। তারা এটাও দাবি করতে চায়, ওই প্রকল্পসমূহ গ্রহণের প্রকৃত উদ্দেশ্য হলো—দুর্নীতির মাধ্যমে বড় অঙ্কের অর্থ আত্মসাৎ।

সম্প্রতি প্রকাশিত বিশ্বব্যাংকের প্রতিবেদনে দেখা যায়, বাংলাদেশে বর্তমানে সড়ক, সেতু, উড়ালসেতু ইত্যাদি নির্মাণে প্রতি ইউনিট খরচ পৃথিবীর অন্য উন্নয়নশীল ও উন্নত বিশ্বের যে কোনো স্থানের তুলনায় অনেক বেশি। প্রতিবেদনে, এসব খাতের ব্যয় উন্নত দেশসমূহ এমনকি আমাদের প্রতিবেশী দেশগুলোর চেয়ে কয়েক গুণ বেশি বলে দেখানো হয়েছে।

বেশ কিছু দিন থেকে বিভিন্ন গণমাধ্যমে বিশ্বাসযোগ্য সূত্রের বরাত দিয়ে সুইস ব্যাংকসহ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানে বাংলাদেশি ব্যক্তি ও ব্যক্তি মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠানের বিপুল অঙ্কের অর্থ জমা বা লগ্নি করার খবর প্রচার হয়ে আসছে। সম্প্রতি পানামা পেপারস/প্যারাডাইস পেপার ইত্যাদি নামে খ্যাত ফাঁস হওয়া এ ধরনের কর্মকাণ্ডের তথ্যভাণ্ডারে অনেক বাংলাদেশির নাম পাওয়া গেছে। সন্দেহ করা হয়, এগুলোর সঙ্গে বিপুল অঙ্কের অবৈধ অর্থের সংশ্লিষ্টতা আছে। এসব খবর সরকারবিরোধীদের উপরোক্ত অভিযোগের বিশ্বাসযোগ্যতা বৃদ্ধিতে সহায়তা করে।

সুশাসনে ঘাটতি, যা সরকারের দুর্বলতা হিসেবে বলা হয়, সে বিষয়টি সরকারি দলের নেতা-কর্মীরা মানতে নারাজ। তাদের দাবি, নতুন কোনো সরকার এলেও বর্তমান প্রেক্ষাপটে এর চেয়ে ভালো করা সম্ভব হবে না। লক্ষ্যণীয় বিষয় হলো—সরকারি দলের এ বক্তব্যের সঙ্গে একমত মানুষের সংখ্যাও খুব কম নয়।

আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন সরকার পাঁচ বছর করে দুটি মেয়াদ পার করছে, প্রায় শেষের পথে। ১১তম জাতীয় সংসদ নির্বাচন তাদের জন্য তৃতীয় মেয়াদে ক্ষমতায় আসার লড়াই। বাংলাদেশের মতো স্বল্প সম্পদের দেশে দায়িত্বে থাকার বিষয়টি রাজনৈতিক দলের জন্য নির্বাচনে নেতিবাচক প্রভাব ফেলে।

সীমিত সম্পদের দ্বারা যে কোনো সরকারের পক্ষে সাধারণ দুর্দশাগ্রস্ত অসংখ্য মানুষের সীমাহীন প্রত্যাশা পূরণ বাস্তবে প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়ে। নতুন সরকারের ক্ষমতা গ্রহণের অল্প কিছু দিনের মধ্যে মানুষ তাদের বিষয়ে হতাশাগ্রস্ত হতে শুরু করে। পরবর্তী নির্বাচনে তারা সাধারণত সরকারের বিপক্ষে অবস্থান নেয়। বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর থেকে আজ পর্যন্ত যতগুলো নির্বাচন সুষ্ঠু, অবাধ হিসেবে দেশে ও বিদেশে গ্রহণযোগ্যতা লাভ করেছে তার সবগুলোতে সরকার পরিবর্তনের রায় দিয়েছে জনগণ। এ অবস্থার প্রেক্ষাপটে বর্তমান সরকার কি অবাধ, সুষ্ঠু ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন অনুষ্ঠানের ঝুঁকি নিতে চাইবে? অনেকেই এ বিষয়ে সন্দিহান।

এখানে প্রশ্ন থেকেই যাচ্ছে, নির্বাচনের সময় যে পরিস্থিতি বিরাজমান থাকবে তাতে আদৌ এ ধরনের কিছু করা সম্ভব হবে কি? তা ছাড়া, কারচুপির মাধ্যমে ফলাফল ঘোষণা করা হলে (যদি হয়) তা দেশে-বিদেশে গ্রহণযোগ্যতা পাবে কি?

অনেকে উদ্বেগ প্রকাশ করছেন, এ ধরনের কিছু সম্ভব হলে দেশে গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থার অবসান হতে পারে। সেটা হলে, সরকারের স্বচ্ছতা রক্ষার ও জবাবদিহিতার আওতায় থাকার বিষয়সমূহ মারাত্মকভাবে বাধাগ্রস্ত হবে। ফলশ্রুতিতে আইনের শাসনে ঘাটতি হতে পারে। দুর্নীতি অপ্রতিরোধ্য, জনকল্যাণ ও জননিরাপত্তা সংশ্লিষ্ট সেবাসমূহ অকার্যকর হয়ে পড়তে পারে। রাজনৈতিক মতপার্থক্য বৃদ্ধি পেয়ে স্থিতিশীলতার আরও অবনতি হতে পারে। সরকারবিরোধী আন্দোলনের দিকে দেশ ধাবিত হতে পারে। ভিন্ন মতাবলম্বীদের বলপ্রয়োগে দমনের উদ্যোগ, চরমপন্থা বা জঙ্গিবাদের উত্থানে সহায়ক হতে পারে। ধরে নেই যদি অবাধ, সুষ্ঠু ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন করা যায়, সেক্ষেত্রে বিভিন্ন ফলাফলের কারণে সম্ভাব্য রাজনৈতিক পরিস্থিতিসমূহ হবে নিম্নরূপ : (ক) যদি বর্তমান জোট সরকার পুনরায় নির্বাচিত হয়, রাজনৈতিক পরিস্থিতি স্থিতিশীল ও স্বাভাবিক থাকবে।

(খ) যদি বর্তমান সরকার নির্বাচনে পরাজিত হয়, সরকারি দলের নেতা-কর্মী সমর্থকদের ওপর প্রতিশোধমূলক হিংসাত্মক আক্রমণ, হত্যা, লুণ্ঠন, অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটার ও দেশে একটি অরাজক পরিস্থিতি সৃষ্টি হওয়ার আশঙ্কা আছে।

আগেই বলা হয়েছে অনেকে মনে করেন, যদি নির্বাচন অবাধ ও সুষ্ঠু না হয় সে ক্ষেত্রে দেশ সংঘাত ও অনিশ্চয়তার গভীর অন্ধকার গহ্বরে নিমজ্জিত হতে পারে।

বলা যায়, নির্বাচনের চেয়ে নির্বাচনকে ঘিরে যে দ্বন্দ্ব ও সংঘর্ষের পরিবেশ সৃষ্টি হচ্ছে সেদিকে বেশি মনোযোগী হওয়া আবশ্যক হয়ে পড়েছে। নির্বাচনকে কেন্দ্র করে বিপদের যে আবর্ত ঘূর্ণিঝড়ের মতো ক্রমাগত শক্তিশালী রূপ ধারণ করছে সেটাকে যথাশিগগির সম্ভব যে কোনোভাবে প্রশমিত করতে হবে।

নির্বাচনের আগেই নিরপেক্ষ রাজনৈতিক পরিবেশ সৃষ্টির ও সে কাজের সময়সীমা নির্দিষ্ট করতে হবে, যাতে করে রাজনীতিতে পরস্পরের ওপর রাগ-বিদ্বেষের পরিবর্তে আস্থা ও সদ্ভাবের পরিবেশ সৃষ্টি করা যায়। এ লক্ষ্যে, বর্তমান সরকারের বিকল্প হিসেবে নিরপেক্ষ একটি সর্বদলীয় বা দলনিরপেক্ষ ব্যক্তিবর্গের সরকার; বর্তমান সরকার প্রধানকে বহাল রেখে বা বহাল না রেখে করা যেতে পারে। সে ক্ষেত্রে প্রতিদ্বন্দ্বী দলগুলো আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে এ সরকারের মেয়াদ নির্দিষ্ট করতে পারে। দলনিরপেক্ষ সরকার গঠন বা সরকার প্রধানকে বাদ দিয়ে কিছু করার বিধান বর্তমান সংবিধানে নেই। সেটা করার জন্য সংবিধান সংশোধন প্রয়োজন হবে। বৃহৎ আকারের জাতীয় ঐকমত্য ছাড়া এ কাজটি করা যাবে না। এ মুহূর্তে এটি বাস্তবসম্মত মনে হয় না।

তবে, বিগত দশম সংসদ নির্বাচনের আগে বর্তমান প্রধানমন্ত্রী সংবিধানের ভিতর থেকেই একটি আপসরফামূলক প্রস্তাব জাতির সামনে পেশ করেছিলেন। সেখানে তার নেতৃত্বে সংসদে প্রতিনিধিত্বকারী দলগুলো থেকে মন্ত্রী নিয়ে একটি সর্বদলীয় নির্বাচনকালীন সরকার গঠনের প্রস্তাব তিনি করেছিলেন। বর্তমান পরিবর্তিত পরিস্থিতির আলোকে কিছু সংস্কার করে ওই ধরনের একটি নির্বাচনকালীন সরকার গঠন করা যেতে পারে। সরকারপ্রধান যদি আন্তরিক হন তবে ওই সরকার সব প্রতিযোগী দলের জন্য নির্বাচনে সমান সুযোগ-সুবিধার পরিবেশ সৃষ্টিতে সহায়তা করতে পারবে।

যদি সংশ্লিষ্ট সব পক্ষ জনগণের স্বার্থ ও দেশের ভবিষ্যৎ যথাযথ গুরুত্ব দিয়ে বিবেচনায় আনে, আশা করা যায়, উপরোক্ত পন্থায় একাদশ সংসদ নির্বাচন অবাধ, সুষ্ঠু ও অংশগ্রহণমূলক হবে ও শান্তিপূর্ণভাবে সম্পন্ন করা যাবে। নির্বাচন-উত্তর অনভিপ্রেত কোনো সহিংসতা বা বিশৃঙ্খলার ঘটনা ঘটবে না। রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা বজায় থাকবে, গণতান্ত্রিক অগ্রযাত্রা বাধাহীন হবে ও জাতির সমৃদ্ধি নিশ্চিত হবে।

লেখক : জাতীয় পার্টির কো-চেয়ারম্যান ও সাবেক মন্ত্রী।