জি এম কাদের
প্রকাশ : বুধবার, ২৫ মে, ২০১৬ ০০:০০
| বাংলাদেশ প্রতিদিন |
জাতীয় পার্টির অষ্টম কাউন্সিল সফলভাবে শেষ হয়েছে ১৪ মে। ওই কাউন্সিলে সাড়া দিয়ে ব্যাপক উৎসাহ-উদ্দীপনা নিয়ে বিপুলসংখ্যক নেতা-কর্মী সমবেত হয়েছিলেন। দেশের সব অঞ্চল থেকে তৃণমূল পর্যায়ের নেতা-কর্মীদের এ ধরনের বড় গণজমায়েত জাতীয় পার্টির সাংগঠনিক কাঠামোর ইতিবাচক দিক ও রাজনৈতিক শক্তির পরিচয় বহন করে। জাতীয় কাউন্সিলের দুটি মুখ্য উদ্দেশ্য ছিল। আগামী মেয়াদের জন্য পার্টির কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব নির্বাচন ও বিগত দিনের রাজনীতি পর্যালোচনা করে আগামী রাজনীতির দিকনির্দেশনা নির্ধারণ। বর্তমান রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে, জাতীয় পার্টির এ কাউন্সিল অত্যন্ত গুরুত্ববহ। এ কাউন্সিল থেকে পার্টির নেতা-কর্মীদের যেমন অনেক প্রত্যাশা, তেমনি সাধারণ জনগণের মধ্যে আছে কাউন্সিল নিয়ে কৌতূহল। অনেকে কাউন্সিল থেকে বড় ধরনের কিছু আশাও করেন। সাধারণ নেতা-কর্মীরা প্রত্যাশা করেন, কাউন্সিলের পর দল সাংগঠনিকভাবে সুশৃঙ্খল ও শক্তিশালী হবে। দলে নবপ্রাণের সূচনা হবে। লোক সমাগম সাংগঠনিক শক্তির ইঙ্গিত হলেও শক্তিশালী সংগঠনের একমাত্র লক্ষণ নয়। মানুষগুলোকে হতে হবে ঐক্যবদ্ধ। ঐক্যবদ্ধ হওয়ার জন্য প্রয়োজন এক ও অভিন্ন নেতৃত্বের প্রতি আনুগত্য ও আস্থা। সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য এবং সার্বিকভাবে দৃঢ় শৃঙ্খলাবোধও জরুরি। সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য অর্জনে, এক ও অভিন্ন নেতৃত্বে সুশৃঙ্খল-একতাবদ্ধ কর্মী বাহিনী তৈরি করে সাংগঠনিক কাঠামো। সেখানে সদস্যরা সংখ্যায় যত বেশি, তত বেশি শক্তিশালী সংগঠন। ফলে নেতা-কর্মীদের প্রত্যাশা বাস্তবায়নে স্বাভাবিকভাবে যে বিষয়গুলো প্রাধান্য পাওয়ার কথা, তা হলো এক ও অভিন্ন নেতৃত্ব সুনির্দিষ্ট রাজনৈতিক লক্ষ্য, দৃঢ়তর দলীয় শৃঙ্খলাবোধ, কর্মী-সমর্থকদের সংখ্যার বিস্তার। সাধারণ মানুষের কৌতূহল জাতীয় পার্টি এই প্রক্রিয়ায় অগ্রসর হতে পারবে কিনা। কাউন্সিলের পর জাতীয় পার্টির রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে এ ধারার বিকাশ চোখে পড়বে কিনা। যদি ইতিবাচক কিছু লক্ষ্য করা যায়, তাহলে তাদের আশা, বর্তমান রাজনৈতিক সংস্কৃতির বাইরে জাতীয় পার্টি নতুন ধারার রাজনীতির প্রচলনে অগ্রণী ভূমিকা পালন করুক। সাধারণ মানুষের ধারণা, রাজনীতির বর্তমান ধারা ক্রমান্বয়ে রাজনীতিকে দুর্বৃত্ত চক্রের ব্যবসায়িক পণ্যে রূপান্তরিত করছে। জনগণ ও জনগণের স্বার্থ রাজনীতিতে প্রায় নির্বাসিত। অর্থ ব্যবহারে পদ-পদবি, মনোনয়ন পাওয়া, রাজনীতিতে অর্থ ও পেশিশক্তির প্রভাব, সরকারি দলের দাপট, প্রশাসনে ব্যাপক দলীয়করণ, দলীয়করণকৃত প্রশাসনের ক্ষমতার অপব্যবহার, দুর্নীতিগ্রস্ত নির্বাচন ব্যবস্থা, সব মিলিয়ে রাজনীতি বর্তমানে নৈতিকতাবিমুখ ও মানে নিম্নমুখী বলে সাধারণ মানুষের উপলব্ধি। বিষয়টি এখানেই থেমে থাকেনি অসাধু দুর্বৃত্ত চক্রের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত জনস্বার্থবিরোধী কর্মকাণ্ডের অনেক কিছুই চলছে রাজনীতির নামে। ফলে রাজনীতি হয়ে উঠেছে সুশাসনের অন্তরায়। সামাজিক ন্যায়বিচারভিত্তিক সমাজ ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠায় বাধা ও দুর্নীতি বিস্তারে সহায়ক। দেশের বেশির ভাগ মানুষ এভাবেই দেখছে বর্তমান ধারার রাজনীতিকে। রাজনৈতিক পরিবেশ স্বস্তিদায়ক, সুষ্ঠু ও স্থিতিশীল না থাকায় দেশে বিনিয়োগ আশাপ্রদ হচ্ছে না। ফলে কর্মসংস্থানের সুযোগ ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যার সঙ্গে তুলনামূলকভাবে অপ্রতুল। বেকার সমস্যা মহামারীর ন্যায় ছড়িয়ে পড়ছে। ঔপনিবেশিক আমলে যে বিষয়টি নিয়ে দেশবাসী সবচেয়ে বেশি উদ্বিগ্ন ছিল তা হলো দেশীয় সম্পদ পাচার হয়ে অন্য দেশে চলে যাওয়া। দুর্ভাগ্যবশত এখনো দেশের বিশাল অর্থ বর্ধিতহারে বিদেশে পাচার হচ্ছে বলে দেশি-বিদেশি গণমাধ্যমের তথ্য থেকে জানা যাচ্ছে। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নাজুক হয়ে উঠছে প্রতিদিন। সাধারণ মানুষ নিরাপত্তাহীনতা ও দুশ্চিন্তায় জীবন কাটাচ্ছে। জনগণ চায় এর থেকে মুক্তি। জনগণ চায় জনস্বার্থের রাজনীতি। সে জন্য তাদের চাহিদা একটি জনগণের রাজনৈতিক দল। সে দলের নেতৃত্ব ও কর্মী বাহিনী হবে ব্যক্তিগত জীবনে স্বচ্ছ, নিষ্ঠাবান, রাজনৈতিকভাবে সর্বদাই জনগণের পক্ষে। হঠাৎ করে অল্প সময়ে রাজনৈতিক সংস্কৃতির পরিবর্তন সম্ভব হবে না। তবে সে প্রক্রিয়ায় পথ চলা শুরু হতে হবে কোনো না কোনো সময়। কাউকে না কাউকে এ পথে কাণ্ডারি হতে হবে। জনগণ জাতীয় পার্টিকে এ ধরনের একটি রাজনৈতিক দল হিসেবে ভবিষ্যতে দেখবে এমনটি আশা করে। জাতীয় পার্টির একটি কর্মোজ্জ্বল অতীত আছে। তাছাড়া দীর্ঘদিন থেকে দলটি ক্ষমতার বাইরে আছে। বর্তমান অপরাজনীতি সৃষ্টিতে জাতীয় পার্টির ভূমিকা নেই বা রাখার সুযোগ ছিল না বলা যায়। অনেকেই আশা করে যেহেতু জাতীয় পার্টি জাতীয় পর্যায়ে অন্য দুটি রাজনৈতিক দলের ন্যায় এখনো এ বিষয়ে সুনির্দিষ্টভাবে পরীক্ষিত নয়, সুযোগ দিলে উৎসাহিত করলে তারা হয়তো রাজনীতিতে পরিবর্তনের উদ্যোগ নিতে পারে। এ পরিপ্রেক্ষিতে, জনগণের স্বপ্ন পূরণে আগামীদিনের জাতীয় পার্টি হতে পারে সেই প্রত্যাশিত ‘জনগণের রাজনৈতিক দল’। জনগণের দল হওয়ার জন্য প্রাথমিকভাবে দলের মালিকানা সত্যিকার অর্থে সদস্যদের হাতে ন্যস্ত হতে হবে। আপন সন্তানের ন্যায় তারা দলকে বিপদে-আপদে আগলে রাখবেন, লালন-পালন করবেন ও সঠিক পথে ধরে রাখবেন, সাধারণ সদস্যদের সে ধরনের ক্ষমতায়ন করতে হবে। যথাযথ অনুপ্রেরণায় উজ্জীবিত করতে হবে। ক্রমান্বয়ে তৃণমূল পর্যায় থেকে কর্মীরা সৃষ্টি করবে নেতৃত্ব, এ সংস্কৃতি গড়ে তুলতে হবে। দলের সব অর্থায়ন ও নীতিনির্ধারণে সাধারণ সদস্যদের সম্পৃক্ততা ও মতামতের প্রতিফলন থাকতে হবে। জনগণের দল হতে হলে পরবর্তীতে যা প্রয়োজন তা হলো জনগণের প্রত্যাশা অনুযায়ী কর্মী বাহিনী সৃষ্টি ও জনগণের পক্ষে রাজনীতি পরিচালনা। উল্লিখিত সংস্কারমূলক কার্যকলাপের পাশাপাশি এ মুহূর্তে জাতীয় পার্টির রাজনীতি হতে পারে ‘সরকার ও প্রশাসনের জনকল্যাণমূলক কাজে সহযোগিতা করা, কিন্তু সব জনস্বার্থবিরোধী কর্মকাণ্ডের বিরুদ্ধে জনগণের পক্ষ হয়ে বলিষ্ঠ ভূমিকা রাখা।’ হলেখক : কো-চেয়ারম্যান, জাতীয় পার্টি।