স্বাধীন বাংলাদেশের স্থপতি, সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি, জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকীতে তাঁকে শ্রদ্ধা জানাচ্ছি।

পরম শ্রদ্ধা ও হৃদয় নিংড়ানো ভালোবাসা নিয়ে, কৃতজ্ঞচিত্তে সমগ্র জাতি আজ তাঁকে স্মরণ করছে। তিনি আলোকবর্তিকা হয়ে আমাদের সামনে; কোনো বাধা-বিপত্তি, বিপদে আমরা ভীত নই, উদ্বেগ, উৎকণ্ঠায় আমরা সন্ত্রস্ত নই। তাঁর কর্মময় জীবনের বিভিন্ন অধ্যায় আমাদের জন্য অনুকরণীয় দৃষ্টান্ত, সুস্পষ্ট দিকনির্দেশনা ও অনুপ্রেরণার উৎস।জাতির জনকের জন্মশতবর্ষ পালনের আনন্দের মুহূর্তেও মনটা ভারাক্রান্ত হয়। বাঙালি জাতির ইতিহাসের জঘন্য অধ্যায় ১৯৭৫-এর ১৫ আগস্টের বর্বর হত্যাকান্ডের কথা জাতি কখনই ভুলতে পারে না। সেদিন ঘাতক হায়েনার দল সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি, জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে নির্মমভাবে হত্যা করে। একই সঙ্গে জাতির জনকের মহীয়সী সহধর্মিণী বঙ্গমাতা ফজিলাতুন নেছা মুজিব, জাতির জনকের তিন পুত্র- শেখ কামাল, শেখ জামাল, শিশু শেখ রাসেল, পুত্রবধূ- সুলতানা কামাল ও পারভীন জামান রোজী, বঙ্গবন্ধুর ছোট ভাই শেখ আবু নাছের, ভগ্নিপতি ও তৎকালীন মন্ত্রী আবদুর রব সেরনিয়াবাত ও তাঁর পরিবারের সদস্যবৃন্দ, আওয়ামী যুবলীগের প্রতিষ্ঠাতা শেখ ফজলুল হক মণি এবং সামরিক সচিব ব্রিগেডিয়ার জেনারেল জামিল আহমেদসহ আরও অনেককে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়। এ ছিল পৃথিবীর ইতিহাসের ভয়াবহতম নারকীয় হত্যাকান্ড। আমি রক্তস্নাত আগস্টে তাঁদের সবাইকে অত্যন্ত দুঃখ ভারাক্রান্ত হৃদয়ে স্মরণ করছি এবং পরম করুণাময় আল্লাহর কাছে তাঁদের আত্মার মাগফিরাত কামনা করছি। ১৯২০ সালের ১৭ মার্চ রাত ৮টায় বঙ্গবন্ধু গোপালগঞ্জের টুঙ্গিপাড়ায় জন্মগ্রহণ করেন। এ বছরের ১৭ মার্চ জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমানের জন্মশতবার্ষিকীর বছরব্যাপী অনুষ্ঠানসূচি শুরু হয়েছে। জন্মশতবর্ষের উদ্বোধনে নান্দনিক আনুষ্ঠানিকতায় নয়াদিল্লি থেকে ভিডিওবার্তায় ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র দামোদর মোদি বলেছেন, ‘জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের শততম জন্মবার্ষিকী উপলক্ষে সমগ্র বাংলাদেশকে আপনাদের ১৩০ কোটি ভারতীয় ভাই-বন্ধুদের পক্ষ থেকে অনেক অনেক অভিনন্দন ও শুভ কামনা।’ তিনি বলেছেন, ‘বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান গত শতাব্দীর মহান ব্যক্তিত্বদের মধ্যে অন্যতম। তাঁর সমগ্র জীবন আমাদের সবার জন্য অনেক বড় প্রেরণা।’

জাতিসংঘ মহাসচিব অ্যান্তোনিও গুতেরেস, নেপালের রাষ্ট্রপতি বিদ্যা দেবী ভান্ডারী, ভুটানের প্রধানমন্ত্রী লোটে শেরিং এবং ওআইসি মহাসচিব ইউনুস বিন আহমদ আল ওথাইমান ভিডিওবার্তায় শুভেচ্ছা বক্তব্য দিয়েছেন। করোনাভাইরাস মহামারী বিশ্বকে অস্থির করে না তুললে ঢাকায় বিশ্ব নেতৃবৃন্দের মিলনমেলা ঘটত। জাতীয় সংসদে বিরোধী দলের পক্ষ থেকে জাতির জনকের প্রতি শ্রদ্ধা প্রদর্শনের জন্য বিশ্ব নেতৃবৃন্দকে জানাই কৃতজ্ঞতা।

বঙ্গবন্ধু সারা জীবন গরিব-দুঃখী, মেহনতি-বঞ্চিত মানুষের পাশে ছিলেন। তাদের ন্যায্য দাবি আদায়ের সংগ্রামে, তাদের অধিকার রক্ষায় ছিলেন অবিচল। সমাজের অন্যায়-অবিচার, অত্যাচার ও বৈষম্যের বিরুদ্ধে তিনি ছিলেন সদা সোচ্চার। জনকল্যাণে নিবেদিত এই নেতা জনস্বার্থের প্রশ্নে কখনই আপস করেননি। ভয়ভীতি, ব্যক্তিগত ক্ষয়ক্ষতি এমনকি জীবনের ঝুঁকি নিতে পিছপা হননি। ১৮ বার পাকিস্তানি শাসক গোষ্ঠী বঙ্গবন্ধুকে কারাগারে পাঠিয়েছে। মোট সাড়ে ১৩ বছরের মতো তিনি কারাগারে বন্দী ছিলেন। অর্থাৎ তিনি তাঁর মোট ৫৫ বছর জীবনকালের প্রায় এক চতুর্থাংশ কারাভ্যন্তরে কাটিয়েছেন। মোকাবিলা করেছেন ২৪টি মামলা। কিন্তু পাকিস্তানি শাসক গোষ্ঠীর সঙ্গে কখনই আপস করেননি।

তাঁর রাজনৈতিক জীবনের শুরু ১৯৪০ সালে। নিখিল ভারত মুসলিম ছাত্র ফেডারেশনে যোগদানের মাধ্যমে। ১৯৪৬ সালে সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন ইসলামিয়া কলেজ স্টুডেন্টস ইউনিয়নের। এ সময় তিনি হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর সঙ্গে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা নিরসনে কাজ করেন কলকাতায়। ভাষা আন্দোলনের সময় ছাত্রনেতা হিসেবে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন শেখ মুজিব। ১৯৪৮ সালে ভাষার প্রশ্নে তাঁর নেতৃত্বেই প্রথম প্রতিবাদ এবং ছাত্র ধর্মঘট শুরু হয় যা চূড়ান্ত রূপ নেয় ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারিতে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র থাকা অবস্থায় তিনি চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারীদের দাবি আদায়ের আন্দোলনে জড়িয়ে পড়েন, যার জন্য তাঁকে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে জরিমানা করা হয়। এ জরিমানাকে অবৈধ ঘোষণা করে তা প্রদান থেকে বিরত থাকেন। সে কারণে তাঁকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বহিষ্কার করা হয়। পঞ্চাশের দশক তাঁর রাজনৈতিক উত্থানের কাল। ধীরে ধীরে তিনি হয়ে ওঠেন দূরদর্শী ও প্রজ্ঞাসম্পন্ন এক কুশলী রাজনৈতিক নেতা। এ সময় শেখ মুজিব মুসলিম লীগ ছেড়ে দেন এবং হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী ও মওলানা ভাসানীর সঙ্গে মিলে গঠন করেন আওয়ামী মুসলিম লীগ। তিনি এ দলের প্রথম যুগ্মসাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। ১৯৫৩ সালে তিনি দলের সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব্ পান। ১৯৫৪ সালের সাধারণ নির্বাচনে জয়ী হয়ে যুক্তফ্রন্ট সরকারের কৃষিমন্ত্রী হন শেখ মুজিব।

১৯৬২ সালে পাকিস্তানের সামরিক স্বৈরশাসক আইয়ুব খানের বিরোধিতা করার কারণে গ্রেফতার হন। ১৯৬৩ সালে তাঁর রাজনৈতিক দীক্ষাগুরু হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর মৃত্যু হলে তিনি আওয়ামী লীগের সভাপতি নির্বাচিত হন। ১৯৬৬ সালে লাহোরে অনুষ্ঠিত বিরোধী দলগুলোর জাতীয় সম্মেলনে শেখ মুজিবুর রহমান ঐতিহাসিক ছয় দফা দাবি উত্থাপন করেন। এ ছয় দফা ছিল পূর্ব পাকিস্তানের স্বায়ত্তশাসনের রূপরেখা।

মুজিবের ছয় দফার প্রতি জনগণের ব্যাপক সমর্থনে ভীত হয়ে তৎকালীন পাকিস্তানি শাসক গোষ্ঠী আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায় গ্রেফতার করে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকে। এতে ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে বাংলার জনগণ। জনরোষের কাছে নতি স্বীকার করে এক পর্যায়ে তাঁকে মুক্তি দিতে বাধ্য হয় শাসক গোষ্ঠী। মুক্তিলাভের অব্যবহিত পরে ১৯৬৯ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি ঢাকা রেসকোর্স ময়দানে কেন্দ্রীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের উদ্যোগে শেখ মুজিবুর রহমানকে গণসংবর্ধনা দেওয়া হয়। সেখানেই উত্থাপিত হয় ১১ দফা দাবি, যার মধ্যে ছয় দফার সব দফাই অন্তর্ভুক্ত ছিল। লাখো মানুষের এ জমায়েতে শেখ মুজিবুর রহমানকে ‘বঙ্গবন্ধু’ উপাধিতে ভূষিত করা হয়।

১৯৬৯ সালের ৫ ডিসেম্বর আয়োজিত এক জনসভায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব পূর্ব বাংলার নামকরণ করেন বাংলাদেশ। তিনি বলেন, ‘একসময় এ দেশের বুক হইতে, মানচিত্রের পৃষ্ঠা হইতে বাংলা কথাটির সর্বশেষ চিহ্নটুকুও চিরতরে মুছিয়ে ফেলার চেষ্টা করা হইয়াছে। একমাত্র বঙ্গোপসাগর ছাড়া আর কোনো কিছুর নামের সঙ্গে বাংলা কথাটির অস্তিত্ব খুঁজিয়া পাওয়া যায় নাই। জনগণের পক্ষ হইতে আমি ঘোষণা করিতেছি- আজ হইতে পাকিস্তানের পূর্বাঞ্চলীয় প্রদেশটির নাম পূর্ব পাকিস্তানের পরিবর্তে শুধুমাত্র বাংলাদেশ।’

১৯৭০ সালের সাধারণ নির্বাচনে তাঁর দল পূর্ব পাকিস্তানের ১৬৯টি আসনের মধ্যে ১৬৭টিতে জয়লাভ করে পাকিস্তানের সংখ্যাগরিষ্ঠ দল হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে এবং প্রাদেশিক পরিষদের ৩১০টি আসনের মধ্যে ৩০৫টি লাভ করে। এর মাধ্যমে বঙ্গবন্ধু সারা বাংলাদেশের একচ্ছত্র নেতা ও বাংলাদেশের সমগ্র জনগোষ্ঠীর একমাত্র বৈধ প্রতিনিধি হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেন। পশ্চিম পাকিস্তানের শাসক গোষ্ঠী মুজিবের স্বায়ত্তশাসনের নীতির পুরোপুরি বিপক্ষে ছিল। আওয়ামী লীগের সরকার গঠন ঠেকাতে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া সংসদের অধিবেশন ডাকা নিয়ে টালবাহনা শুরু করেন। শেখ মুজিব তখনই বুঝে যান যে, পশ্চিম পাকিস্তানি শাসকদের দুঃশাসনের অবসান ঘটাতে লড়াইয়ের কোনো বিকল্প নেই।

১৯৭১ সালের ৭ মার্চ রেসকোর্স ময়দানে এক ঐতিহাসিক ভাষণে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান স্বাধীনতার ডাক দেন। রেসকোর্সের জনসমুদ্রে ঘোষণা করেন, ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম’। ঐতিহাসিক এ ভাষণে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু বাঙালি জাতিকে শৃঙ্খলমুক্তির আহ্বান জানিয়ে ঘোষণা করেন, ‘রক্ত যখন দিয়েছি, রক্ত আরও দেব, এ দেশের মানুষকে মুক্ত করে ছাড়ব ইনশা আল্লাহ’। ২৫ মার্চ পাকিস্তানি বাহিনী সারা দেশে চালায় নৃশংস হত্যাকান্ড। পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর হাতে তিনি গ্রেফতার হন। ফাঁসির মঞ্চে দাঁড়িয়েও তিনি আপস করেননি। বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে দীর্ঘ নয় মাস সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে আমরা বিজয় লাভ করি। বঙ্গবন্ধু এ দেশের জনগণের রাজনৈতিক স্বাধীনতার সঙ্গে অর্থনৈতিক মুক্তির জন্য আজীবন সংগ্রাম করে গেছেন। তিনি ঘোষণা করেছিলেন দ্বিতীয় বিপ্লবের। ক্ষুধা ও দারিদ্র্যমুক্ত সোনার বাংলা গড়াই ছিল তাঁর জীবনের মূল লক্ষ্য। কার্যত বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশকে অর্থনৈতিক বৈষম্যহীন উন্নত দেশ বিনির্মাণের জন্য নিয়েছিলেন সর্বাত্মক উদ্যোগ। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট ঘাতকেরা বঙ্গবন্ধুর সেই স্বপ্নকে সপরিবারে হত্যা করে শেষ করে দিতে চেয়েছে। ঘাতকের সেই আকাক্সক্ষা পূরণ হয়নি। তাঁর সুযোগ্য কন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার হাত ধরে বাংলাদেশ আজ উন্নতির মহাসড়কে। বাংলাদেশ আজ উন্নয়নের রোল মডেল। দক্ষিণ এশিয়ার সবচেয়ে সম্ভাবনাময় দেশ।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ছিলেন বাঙালি জাতির অবিসংবাদিত নেতা, বাংলাদেশের স্বাধীনতার রূপকার। বাঙালি জাতির হাজার বছরের ইতিহাসে তাঁর সমতুল্য আর কোনো নেতার জন্ম হয়নি। ভাষা আন্দোলনে তাঁর অবদান অবিস্মরণীয়। স্বাধিকার আন্দোলন থেকে শুরু করে স্বাধীনতা সংগ্রামের দীর্ঘ সময়টুকু সমগ্র বাঙালি জাতি দলমত, ধর্মবর্ণ, ধনীদরিদ্র, শিক্ষিত-অশিক্ষিত সবাই তাঁর নেতৃত্বে ঐক্যবদ্ধ হয়ে তাঁর প্রতিটি আদেশ-নির্দেশ অক্ষরে অক্ষরে পালন করে গেছে। এ বিষয়ে কোনো দ্বিধাদ্বন্দ্ব বা প্রশ্ন উত্থাপন করেনি। এই সময়ে তিনি প্রাতিষ্ঠানিকভাবে ক্ষমতায় ছিলেন না।

তাঁর কর্মময় সংগ্রামী জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে দেশপ্রেম, প্রজ্ঞা, ত্যাগ, কঠোর মনোবল ও সাহসিকতা তাঁকে সবার কাছে গ্রহণযোগ্য করেছে। সবাই তাঁকে পরম বিশ্বাস ও আস্থার সঙ্গে অন্তরে স্থান দিয়েছে। তিনি ছিলেন সর্বস্তরের গণমানুষের অন্তরের নেতা ও সেই অবস্থান থেকেই তিনি হয়েছেন চিরঅম্লান, চিরভাস্বর, চিরঞ্জীব।

 লেখক : রাজনীতিবিদ।