বিশেষ সাক্ষাৎকার | kalerkantho.com
বিরোধীদলীয় নেতার বিষয়ে সিদ্ধান্ত দলীয় ফোরামে
জাতীয় পার্টির প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ মৃত্যুর আগেই ছোট ভাই জি এম কাদেরকে তাঁর উত্তরসূরি মনোননীত করে গিয়েছিলেন। এরশাদের মৃত্যুর পর দলের পক্ষ থেকে জি এম কাদেরকে দলের চেয়ারম্যান ঘোষণা করা হয়েছে। দলের একটি অংশ অবশ্য এই সিদ্ধান্ত মানতে নারাজ। ওদিকে জাতীয় সংসদে বিরোধী দলের নেতা কে হবেন, সে বিষয়েও কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি। এসব বিষয় নিয়ে কালের কণ্ঠ’র মুখোমুখি হয়েছিলেন জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান জি এম কাদের এমপি। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন এনাম আবেদীন

কালের কণ্ঠ : জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান হওয়ার পর নতুন কী করতে চান আপনি?

জি এম কাদের : জাতীয় পার্টিকে আমি সামনের দিকে আরো এগিয়ে নিয়ে যেতে চাই। আমি লক্ষ করেছি, সারা দেশেই পার্টির প্রয়াত নেতা আমার পিতৃতুল্য বড় ভাই হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের কমবেশি সমর্থক আছে। রংপুরে এই মাত্রাটা একটু বেশি। তা ছাড়া সংগঠনও সারা দেশে আছে। সারা দেশের এই সংগঠনের সঙ্গে সমর্থকদের নিবিড় সম্পর্ক গড়ে তুলতে চাই আমি।

কালের কণ্ঠ : আপনি সংগঠন গোছানোর কথা বলছেন?

জি এম কাদের : সংগঠন তো একটি বিষয়। তা ছাড়া আমার দৃষ্টিতে বাংলাদেশে এখন এক ধরনের রাজনৈতিক শূন্যতা আছে। সরকারের বিরুদ্ধে যে রাজনৈতিক মঞ্চ বর্তমানে আছে, সেটি খুবই দুর্বল। তারা সেভাবে দাঁড়াতে পারছে না, যদিও তারা বলছে যে সরকার তাদের দাঁড়াতে দিচ্ছে না। কিন্তু সরকার থেকে বলা হচ্ছে, তাদের শক্তিই নেই। বাস্তবতা হলো, তারা মাঠে নেই। অন্যদিকে সরকার সমর্থকদের অনেকের প্রত্যাশাও পূরণ হচ্ছে না। অনেকের মধ্যেই এ নিয়ে অসন্তুষ্টি আছে। সেই শূন্যতার দিকে লক্ষ রেখেই জাতীয় পার্টিকে আমি একটি শক্তিশালী কাঠামো দিতে সচেষ্ট হব।

কালের কণ্ঠ : এ জন্য তো জাতীয় পার্টিকে ঐক্যবদ্ধ থাকা দরকার, সেটি কি আছে?

জি এম কাদের : এর জবাব আমি একটু পরে দিতে চাই। আমি সংগঠন গড়ে তোলার সঙ্গে সঙ্গে দেশের জনগণের প্রত্যাশা অনুযায়ী কিছু রাজনৈতিক কর্মসূচিও পালন শুরু করব সংসদে এবং সংসদের বাইরে। প্রতিটি বিভাগের জন্য ক্রাইসিস ম্যানেজমেন্ট গড়ে তোলার চেষ্টা করছি। বন্যা ও ডেঙ্গু পরিস্থিতি নিয়ে জাতীয় পার্টি জনগণের পাশে থাকার মতো কর্মসূচি দেবে। সংসদে সরকারের গঠনমূলক সমালোচনা করা হবে।

কালের কণ্ঠ : জাতীয় পার্টি ঐক্যবদ্ধ আছে কি না?

জি এম কাদের : বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতি দাঁড়িয়ে গেছে যে নেতাভিত্তিক দল। নেতার প্রাধান্য ও গুরুত্ব বেশি থাকে। এটির ভালো ও খারাপ দুই দিকই আছে। খারাপ হলো, এ ধরনের পরিস্থিতিতে ‘নেতা’র মৃত্যুর পর এক ধরনের শূন্যতা তৈরি হয়। হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের মতো বড়মাপের একজন নেতার মৃত্যুর পর সারা দেশের জাতীয় রাজনীতিতে শূন্যতার পাশাপাশি জাতীয় পার্টিতেও ব্যাপক শূন্যতার সৃষ্টি হয়েছে। এই শূন্যতার ফলে দলের মধ্যে নেতৃত্ব নিয়ে প্রতিযোগিতা তৈরি হতে পারে। এ প্রতিযোগিতার কোনো কোনো পর্যায়ে দলে ভাঙনের মতো পরিস্থিতিও তৈরি হওয়া অস্বাভাবিক নয়। একপর্যায়ে কিছু নেতা এদিক-ওদিক বা অন্য কোনো দলে চলেও যেতে পারে। এটি বাংলাদেশে খুব স্বাভাবিক একটি প্রক্রিয়া। এ ঘটনা আওয়ামী লীগ ও বিএনপিতেও অতীতে হয়েছে। এমন ঘটনা যে জাতীয় পার্টিতে হবে না, সেটি নিশ্চিত করে বলা যায় না। তবে জাতীয় পার্টিতে এখন যে পরিস্থিতি, তাতে এ ধরনের আশঙ্কা খুবই কম বলে আমি মনে করি। জাতীয় পার্টিকে খুবই কমসংখ্যক মানুষ এখন পর্যন্ত আমার নেতৃত্বের বাইরে অবস্থান করছে।

কালের কণ্ঠ : প্রথম দিকে দৃশ্যমান বিরোধিতা না থাকলেও মঙ্গলবার তো রওশন এরশাদ চিঠি দিয়ে আপনার নেতৃত্ব না মানার কথা বলেছেন।

জি এম কাদের : ওই চিঠি কেউ আমাকে দেয়নি। গণমাধ্যমে দেখেছি। ফলে চিঠির সত্যতা নিয়ে প্রশ্ন আছে। তা ছাড়া দলের উত্তরাধিকার বা ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তো দলের চেয়ারম্যান করে গেছেন। তিনি এখন ইহজগতে নেই। এমন পরিস্থিতিতে তাঁর দেওয়া সিদ্ধান্ত নিয়ে বিতর্ক করলে তাঁর আত্মা কষ্ট পাবে বলে আমি মনে করি। তা ছাড়া এটি শোভন কাজও নয়। দলের প্রত্যেক নেতাকর্মী এরশাদের নেতৃত্বের প্রতি আস্থাশীল ছিল। ফলে এ ধরনের বিতর্কে তারাও অসন্তুষ্ট হবে।

কালের কণ্ঠ : আপনার নেতৃত্বের বাইরে অবস্থানকারীরা কী চাইছে?

জি এম কাদের : তারা যে কী চায়, তার যুক্তিও খুব পরিষ্কার নয়। অসুস্থ থাকায় হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ বেশ অনেক দিন ধরে দায়িত্ব পালন করতে পারছিলেন না। আমিই দায়িত্ব পালন করেছি। সবাই মোটামুটি সমর্থন করেছে এবং আমাকে মেনে নিয়েছে। কেউ কখনো বিরোধিতা করেনি। আবার করলেও তা দৃশ্যমান হয়নি। ফলে দলে বড় ধরনের ভাঙন হবে বলে মনে করি না। আমি বিশ্বাস করি, ঐক্যবদ্ধ দল শক্তিশালী তখন হয়, যখন সবাই একই নেতৃত্ব মেনে নেয়। কারো যদি এটি মেনে নিতে অসুবিধা হয়, তারা দল থেকে চলে গেলে প্রাথমিকভাবে দুর্বল মনে হতে পারে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত দলের খারাপ কিছু হয় না, বরং উপকারই হয়, দল আরো শৃঙ্খলাবদ্ধ হয়। হোমো জিনিয়াস অবস্থানে থাকলে, একমত থাকলে দলকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া অনেক সহজ হয়।

কালের কণ্ঠ : আপনার কথায় তো দলে ভাঙনের আশঙ্কা থেকে যায়।

জি এম কাদের : মনে রাখতে হবে, বঙ্গবন্ধুর মৃত্যুর পর আওয়ামী লীগ ভাগ হয়েছে। দলের অনেক বড় নেতা তখন চলে গেছেন। কিন্তু আওয়ামী লীগ এতে দুর্বল হয়নি। জিয়াউর রহমানের মৃত্যুর পর বিএনপিও ভেঙেছে। অনেক নেতা চলে গেছেন; কিন্তু বিএনপি দুর্বল হয়নি।

কালের কণ্ঠ : তার অর্থ, হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের মৃত্যুর পরও জাতীয় পার্টি ভাঙনের মুখে পড়তে যাচ্ছে?

জি এম কাদের : প্রথমত, ভাঙন হবে—এটা আমি মনে করতে চাই না। দ্বিতীয়ত, হলেও তাতে জাতীয় পার্টি যে খুব বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবে, তা নয়।

কালের কণ্ঠ : বললেন যে দলের কিছু লোকের সমর্থন পাচ্ছেন না! এরা কারা?

জি এম কাদের : প্রেসিডিয়াম বৈঠকে হাতে গোনা দু-চারজন আসেননি। তাঁদের নাম বলতে চাই না। তবে সবাইকে ডাকা হয়।

কালের কণ্ঠ : সংসদে কার্যকর বিরোধী দলের ভূমিকায় যাওয়া কি জাতীয় পার্টির পক্ষে সম্ভব?

জি এম কাদের : কার্যকর কথাটা নিয়ে আমার কিছু বলার আছে। বস্তুত বাংলাদেশে সংসদীয় গণতন্ত্র চালু হলেও সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদসহ কিছু কারণে সংসদীয় ধারার মূল কতগুলো স্পিরিটকে বাধাগ্রস্ত করা হয়েছে। বিরোধী দল হিসেবে আমরা ইচ্ছা করলেও সরকারকে ওই ধরনের জবাবদিহিতে নিতে পারব না বা পদত্যাগে বাধ্য করতে পারব না। বর্তমান ব্যবস্থায় সরকার কোনো প্রস্তাব বা আইন পাস করতে চাইলে তারা পারছে এবং পারবে। বিরোধী দল বাধাগ্রস্ত করতে চাইলেই বর্তমান ব্যবস্থায় তা সম্ভব নয়। সরকার যেটি চাইবে, সেটিই হবে। কারণ সংসদে মেজরিটি পেয়েই তারা সরকার গঠন করেছে। ইংল্যান্ড বা ভারতের মতো সংসদে ভোটাভুটির মাধ্যমে প্রস্তাব বাতিল, সিদ্ধান্ত পরিবর্তন বা সরকার পরিবর্তন বাংলাদেশে সম্ভব নয়, যদিও আমরা সংসদীয় ব্যবস্থায় আছি। অর্থাৎ পুরোপুরি গণতান্ত্রিক ধারায় যে জবাবদিহি, তা আমরা এখানে ব্যবহার করতে পারছি না। সেই অর্থে সংসদ এখানে কখনোই পুরোপুরি কার্যকর ছিল না। সংসদ যা পাস করতে চায়, সব সময়ই তা হয়েছে। যা চায়নি, তা কখনোই পাস হয়নি। কার্যকর বলতে যা বোঝায়, তা কখনোই হয়নি। সত্যিকার অর্থে বলতে হয়, শুধু সরকারি বিলগুলো পাসের আনুষ্ঠানিকতা বলতে যা বোঝায়, যেটিকে ‘রাবার স্ট্যাম্প পার্লামেন্ট’ নামে কেউ কেউ অভিহিত করে, আমাদের পার্লামেন্ট তা-ই। পাতানো খেলা যেটি বলা যায়, অনেকটা ঠিক সে রকমই। পাতানো খেলায় যেমন কে হারবে কে জিতবে সেটি পূর্বনির্ধারিত। এখানে সরকার জিতবে, এটিও পূর্বনির্ধারিত।

কালের কণ্ঠ : কিন্তু অন্তত বক্তৃতায় বিরোধিতা এবং প্রাণবন্ত সংসদ তো আগে ছিল।

জি এম কাদের : ঠিক বিরোধিতা নয়। বিরোধিতার সময় অনেক সময় ভাবভঙ্গি বা ভাষার ব্যবহার হয়েছে। এগুলোকে আমাদের দেশের কালচারে অনেক সময় প্রাণবন্ত মনে করা হয়। সেটি হয়তো এখন হচ্ছে না। কিন্তু একেবারে সমালোচনা হচ্ছে না—এটি ঠিক নয়। আমি আমার বক্তৃতায় সরকারের সমালোচনা করেছি। তবে একটি কথা মনে রাখা দরকার যে আমরা জাতীয় পার্টি কিন্তু আওয়ামী লীগের সঙ্গে জোট গঠন করে নির্বাচনে গিয়েছি। সেখানে সেই জোটের নেতা কিন্তু বর্তমান প্রধানমন্ত্রী। এখানে কিছু নীতিগত ঐকমত্য ছাড়াও চক্ষুলজ্জার অন্তত বিষয় আছে। জনগণের কাছে আমরা যে ইশতেহার বা পরিকল্পনা নিয়ে গেছি, তা বর্তমান সরকারেরও পরিকল্পনা। তাদের নেতাকেও আমরা ভালো বলেছি, নেতা মেনেছি। ফলে এখন আমরা এমন কোনো ভাষা ব্যবহার করতে পারি না, যেটি স্ববিরোধী বা মানুষ গ্রহণ করবে না। আমরা সরকারের কাজের সমালোচনা করতে পারি। কিন্তু ওই ভাষা ব্যবহার করতে পারি না। কারণ আমরা দুই দল একসঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে এবং একই এজেন্ডায় নির্বাচন করেছি।

কালের কণ্ঠ : বিরোধী দল জাতীয় পার্টি হবে, এটি তাহলে অবশ্যই নিশ্চিত ছিল না?

জি এম কাদের : নিশ্চিত থাকে কিভাবে? কারণ সরকারি দল হওয়ার জন্য সরকারের সঙ্গে আমরা জোট গঠন করেছি। আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন জোটের সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে নির্বাচন করেছি এ জন্য যে জয়লাভ করলে আমরা সরকার গঠন করব। এ জোট সরকার গঠন করবে। নির্বাচনে হারলে আমরা বিরোধী দলে যেতাম, সেটি সঠিক ছিল। আওয়ামী লীগের অধীনে বিরোধী দল হওয়ার জন্য তো আমরা নির্বাচন করিনি। কিন্তু পরিস্থিতির কারণে এটি করতে হয়েছে। কারণ বিএনপি সংসদে না গেলে সংসদ গ্রহণযোগ্য হওয়ার বিষয়ে প্রশ্ন থাকতে পারে। বিরোধী দলবিহীন তো সংসদ হতে পারে না। তখন আলাপ-আলোচনার ভিত্তিতেই সব কিছু হলো। আমরা আলাদা মার্কা নিয়ে নির্বাচন করায় আইনগতভাবে সমস্যা হয়নি। সব মিলিয়ে মনে করা হলো, জাতীয় পার্টিকে বিরোধী দলের আসনে বসালে হান্ড্রেড পার্সেন্ট না হলেও কিছুটা অন্তত সংসদ কার্যকর হবে বা স্বাভাবিকতা আসবে।

কালের কণ্ঠ : ওই অর্থে তাহলে জাতীয় পার্টিকে ট্র্যাডিশনাল বা অর্থবহ বিরোধী দল বলা যায় না।

জি এম কাদের : আগের বিরোধী দলগুলো সব সময়ই বিরোধিতা করে কোনো কিছু ঠেকাতে না পেরে সংসদ বর্জন করেছে। আওয়ামী লীগের সময় বিএনপি এবং বিএনপির সময় আওয়ামী লীগ করেছে।

কালের কণ্ঠ : সংসদে বিরোধীদলীয় নেতা শেষ পর্যন্ত কে হচ্ছেন? আপনি, নাকি রওশন এরশাদ?

জি এম কাদের : যেকোনো পলিটিক্যাল সিস্টেমে কয়েকটি অঙ্গ আছে; যেমন—সংসদ একটি, দল একটি। তবে যেকোনো দেশে পার্লামেন্টারি পার্টি দলের নির্দেশনায় চলে। দলই এখানে বড়। তাই বিরোধীদলীয় নেতা বা উপনেতা কে হবেন, সেটি জাতীয় পার্টির দলীয় ফোরামে বসে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে। কারো ইচ্ছা-অনিচ্ছায় এটি হবে না। কারণ দলীয় নির্দেশনাই পার্লামেন্টারি পার্টি ফলো করবে। পার্টি সুপ্রিম অথরিটি। ফলে পার্টি যা বলবে, তা-ই হবে।

কালের কণ্ঠ : একটি কথা ঘুরেফিরে বলা হচ্ছে, মাননীয় প্রধানমন্ত্রী যাঁকে সমর্থন করেন, তিনিই বিরোধীদলীয় নেতা হবেন। এই গুঞ্জনের তাৎপর্য কী?

জি এম কাদের : অনেকেই এটি বলে। কিন্তু কেন বলে, তা জানি না। তবে এটি ঠিক যে জাতীয় পার্টি সরকারের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে আছে বা একই জোটে আছে। সে কারণেই মানুষ মনে করতে পারে। আরেকটি বিষয় হলো, পার্লামেন্টারি সিস্টেম বা রুলস অব প্রসিডিউরে সংসদে স্পিকারের এক ভূমিকা রয়েছে। এটি কোনো লিখিত নিয়ম নেই। তবে বিরোধীদলীয় নেতা হওয়ার বিষয়ে ইচ্ছা করলে হয়তো তিনি মতামত দিতে পারেন। সংসদ নেতার মতামতেরও এ ক্ষেত্রে মূল্য আছে। আবার স্পিকার হয়তো সংসদ পরিচালনার স্বার্থে সংসদ নেতার সঙ্গে আলাপ করতে পারেন। সে কারণে হয়তো অনেকে প্রধানমন্ত্রীর মতামতের কথা মনে করতে পারে। আমাদের মহাজোটের নেতা হচ্ছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। ফলে তাঁকে নেতা মানার প্রবণতা তো আছেই।

কালের কণ্ঠ : জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান ও আপনার ভাই হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ মৃত্যুর আগে আপনাকে কি কোনো উল্লেখযোগ্য কথা বলে গেছেন?

জি এম কাদের : হ্যাঁ। তিনি মারা যাওয়ার আগে নিজের কিছু ইচ্ছা এবং অছিয়তনামাও একটি করে গেছেন আমাকে জানিয়ে। দল পরিচালনা ও পারিবারিক কিছু বিষয়ও বলে গেছেন। জীবনের শেষ সময়ে, ক্রিটিক্যাল কেয়ার ইউনিটে থাকার সময় উনার সঙ্গে আমার সর্বশেষ কথা হয়। সেদিন তাঁকে দেখতে যাওয়ার পরই ডাক্তাররা বললেন, আজ উনি কিছুটা সজাগ আছেন, দেখেন কথা বলতে পারেন কি না। আমি ভাই ভাই বলে ডাকতেই তিনি চোখ তুলে তাকালেন। কী যেন এ সময় তিনি বিড়বিড় করে বলার চেষ্টা করলেন। আমি বুঝতে না পেরে উনার মুখের কাছে কান পেতে বোঝার চেষ্টা করলাম। বললেন, ‘ডাক্তাররা কী বলছেন।’ আমি বললাম আপনি ভালো আছেন—এটাই তাঁরা বলছেন। কিন্তু সেদিন মনে হলো আমার ভাই কথাটা গ্রাহ্য করলেন না এবং বিশ্বাসও করলেন না। তারপর জানতে চাইলাম, আপনি কেমন আছেন। এ সময় তিনি মাথা নাড়লেন। এরপর হঠাৎ করেই স্পষ্টভাবে বললেন, ‘তুই কেমন আছিস?’ এরপর উনার চোখ আস্তে আস্তে বন্ধ হয়ে যায়। বললাম ভাই, আপনি ঘুমান, আমি আবার কালকে আসব। এরপর চলে এলাম। ওটাই লাস্ট দেখা।

কালের কণ্ঠ : দল পরিচালনার ব্যাপারে সুনির্দিষ্টভাবে কোনো নির্দেশনা?

জি এম কাদের : তিনি বারবার একটি কথাই বলেছেন, ‘দলটি তোর ওপর দিয়ে গেলাম। অবস্থা তো খুব ভালো না, তুইতো বুঝতেছিস। দেখ চেষ্টা করে। পারলে তুই-ই পারবি কিছু করতে।’ আসলে এমন একদিন আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতেই ভাই আমাকে দলের দায়িত্ব দিয়েছিলেন। তাঁর কথায় আমি বলেছিলাম যে ভাই, পার্টি তো আপনি আমাকে দিয়ে যাননি। তিনি বললেন, ‘কে বলছে দিয়ে যাইনি! কী করতে হবে বল। লিখে দিয়ে যাব?’ আমি বললাম, আপনার শরীরের যে অবস্থা, মানুষ এখন লেখায়ও বিশ্বাস করতে চাইবে না। যা হোক, পরের দিন আমাকে ডাকলেন। উত্তরাধিকার হিসেবে আমাকে তিনি লিখেও দিলেন, আবার টেলিভিশনেও বলে গেলেন। এটি নিয়ে অনর্থক বিতর্ক হয়েছে, যা দুঃখজনক।

কালের কণ্ঠ : মামলার কারণে হুসেইন মুহম্মদ এরশাদকে সব সময় সরকারের নিয়ন্ত্রণে থাকতে হয়েছে বলে মনে করা হয়। তিনি মারা যাওয়ার পর কি জাতীয় পার্টির রাজনীতিতে এর ব্যত্যয় ঘটবে?

জি এম কাদের : আমার বিরুদ্ধে হয়তো মামলা-মোকদ্দমা নেই। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে, দল চালাতে গেলে সব সময়ই যা ইচ্ছা তা করা সম্ভব নয়। পলিটিকস ইজ অ্যান আর্ট অব অ্যাডজাস্টমেন্ট অ্যান্ড কম্প্রোমাইজ। আমার কারণে নয়, সার্বিকভাবে দলের কারণে। দলের বিষয়ে অনেক কিছু থাকে, যা সব সময় বলাও যায় না, করাও যায় না। দলের স্বার্থে কিছু অ্যাডজাস্টমেন্ট বা কম্প্রোমাইজ হয়তো করতে হবে। অন্যদিকে দেশের স্বার্থে এবং জনগণের স্বার্থে রাজনীতিও করতে হবে। জনগণের স্বার্থের বাইরে যাওয়া যাবে না।

কালের কণ্ঠ : রাজনৈতিক মেরুকরণে আওয়ামী লীগবিরোধী শক্তি এখনো বিএনপিকেই মনে করা হয়। ভবিষ্যতে এই মেরুকরণের কোনো পরিবর্তনের সম্ভাবনা আপনি দেখতে পাচ্ছেন?

জি এম কাদের : পৃথিবীর প্রায় সব দেশেই এ ধরনের মেরুকরণ দেখা যাচ্ছে। একটি লিবারেলস, অন্যটি কনজারভেটিভ। আওয়ামী লীগ লিবারেলসকে প্রতিনিধিত্ব করে তার সঙ্গে বামপন্থীরা থাকার কারণে। বিএনপি এখন পর্যন্ত কনজারভেটিভদের প্রতিনিধিত্ব করছে। রক্ষণশীল ও ধর্মীয় মূল্যাবোধে বিশ্বাসী দলগুলো তাদের সঙ্গে আছে। জাতীয় পার্টি রক্ষণশীল ধারার দল হয়েও লিবারেলস আওয়ামী লীগের সঙ্গে আছে। এখন রক্ষণশীল ফোর্স হিসেবে বিএনপি ইমার্জ করা অবস্থায় আমরা তাদের সঙ্গে অ্যালায়েন্স করলে জাতীয় পার্টির পৃথক অস্তিত্ব বা গুরুত্ব কমে যাওয়ার আশঙ্কা থাকে। আওয়ামী লীগের স্বার্থ হলো, রক্ষণশীলদের কিছু ভোট পাওয়া গেলে তারা সুবিধাজনক অবস্থায় থাকে। তাই তারা আমাদের সঙ্গে রাখার পক্ষে। আমরাও অস্তিত্ব রক্ষার প্রশ্নে তাদের সঙ্গে স্বস্তি বোধ করি। আমি জাতীয় পার্টির নেতাকর্মীদের বলি, আওয়ামী লীগ তোমাদের যত গালাগালি দেবে বা দূরে রাখবে, এটি তাদের জন্য ভালো। কারণ এতে প্রমাণিত হয় যে জাতীয় পার্টি পৃথক রাজনৈতিক একটি সত্তা লালন করে। অর্থাৎ তুমি আওয়ামী লীগ থেকে আলাদা।

কালের কণ্ঠ : বিএনপির সঙ্গে অ্যালায়েন্স হওয়ার সম্ভাবনা ভবিষ্যতে তাহলে কম?

জি এম কাদের : বিএনপির সঙ্গে যাওয়া বা বিএনপি আমাদের সঙ্গে আসাটা ভবিষ্যৎ রাজনীতির ওপর নির্ভর করছে। বিএনপি যদি ভবিষ্যতে ক্ষমতায় আসে বা শক্তিশালী হয়, আর আমরা যদি যাই, তাহলে আমাদের দলটা তাদের মধ্যে ঢুকে বিলীন হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা থাকে। অমন পরিস্থিতিতে হয়তো আর না-ও টিকতে পারে। তাই আমরা বর্তমান রাজনৈতিক শূন্যতার মধ্যে রক্ষণশীলদের নেতৃত্ব নেওয়ার চেষ্টা করছি, যেটি আগেও একবার হয়েছে। জিয়াউর রহমানের মৃত্যুর পর যেমন অনেকে জাতীয় পার্টিতে চলে এসেছিল। তবে একটা ঝুঁকি অবশ্যই এ ক্ষেত্রে আছে। তা হলো, আমরা যত চেষ্টা করি না কেন, আওয়ামী লীগ বা লিবারেলসরা কখনোই তাদের চেয়ে বেশি শক্তিশালী আমাদের হতে দিতে চাইবে না। সহযোগিতা ততটুকুই তারা করবে, যতটুকুতে জাতীয় পার্টি তাদের তুলনায় দুর্বল বা নিচে থাকবে। পাশাপাশি সহযোগিতা এ কারণে করবে, যাতে কনজারভেটিভদের মধ্যে ভাঙন থাকে। তারা দুর্বল থাকে।

কালের কণ্ঠ : আপনাকে ধন্যবাদ।

জি এম কাদের : কালের কণ্ঠকেও ধন্যবাদ।

Link