গোলাম মোহাম্মদ কাদের, এমপি

বাংলাদেশ প্রতিদিন ।। প্রকাশ : শনিবার, ২২ ফেব্রুয়ারি, ২০২০ ০০:০০ টা

আমরা সংসদীয় গণতন্ত্র চর্চা করছি বলা হয়। বাস্তবে বাহ্যিকভাবে আমাদের পদ্ধতি দেখতে তেমনটাই। নির্বাচন দেশময় বিভিন্ন নির্বাচনী এলাকাভিত্তিক হয়। প্রধানমন্ত্রী নির্বাচন এবং সরকার গঠনের পদ্ধতিও সংসদীয় পদ্ধতির সরকারের মতো। কিন্তু সংসদীয় পদ্ধতির মূল নির্যাস, সংসদই হবে সব কর্মকান্ড/ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দু; সংসদে জনগণের প্রতিনিধিদের দ্বারা সরকারের জবাবদিহি নেওয়ার ও দিকনির্দেশনা দেওয়ার মাধ্যমে ক্ষমতায় জনগণের মালিকানা প্রতিষ্ঠার কার্যক্রমসমূহ পরিচালিত হবে; এ প্রক্রিয়ায় জনগণের শাসন বা গণতন্ত্রের চর্চা করা হবে; সে বিষয়ে আমাদের শাসন পদ্ধতিতে যথেষ্ট ঘাটতি আছে বলা যায়।

বলা হয়, আমরা Westminster পদ্ধতি বা ব্রিটিশ পদ্ধতির সংসদীয় গণতন্ত্র চর্চা করি। ব্রিটিশ পদ্ধতিতে সব সংসদ সদস্য স্বাধীনভাবে সংসদে সিদ্ধান্ত বা ভোট দিতে পারেন। আমাদের দেশে সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদের কারণে দলীয় সিদ্ধান্ত মোতাবেক সংসদ সদস্যদের সংসদে অবস্থান নিতে হয়। না হলে তারা তাদের সংসদ সদস্য পদ হারাবেন। আমাদের সংবিধানের বিধান ‘৭০।(১) কোন নির্বাচনে কোন রাজনৈতিক দলের প্রার্থীরূপে মনোনীত হইয়া কোন ব্যক্তি সংসদ সদস্য নির্বাচিত হইলে তিনি যদি উক্ত দল হইতে পদত্যাগ করেন, অথবা সংসদে উক্ত দলের বিপক্ষে ভোটদান করেন, তাহা হইলে সংসদে তাঁহার আসন শূন্য হইবে।ব্যাখ্যা ।- যদি কোন সংসদন্ডসদস্য, যে দল তাঁহাকে নির্বাচনে প্রার্থীরূপে মনোনীত করিয়াছেন, সেই দলের নির্দেশ অমান্য করিয়া- (ক) সংসদে উপস্থিত থাকিয়া ভোটদানে বিরত থাকেন, অথবা (খ) সংসদের কোন বৈঠকে অনুপস্থিত থাকেন, তাহা হইলে তিনি উক্ত দলের বিপক্ষে ভোটদান করিয়াছেন বলিয়া গণ্য হইবে।’

Westminster পদ্ধতিতে সরকারের মন্ত্রিসভার সদস্য ছাড়া বাকি সব সংসদ সদস্য বেসরকারি সদস্য। আমাদের দেশের কার্যপ্রণালি বিধিতেও বিষয়টি অন্তর্ভুক্ত আছে। বাংলাদেশ জাতীয় সংসদের কার্যপ্রণালি-বিধি; প্রথম অধ্যায়; সংক্ষিপ্ত শিরোনাম ও সংজ্ঞা, ১এর-ঢ, ‘বেসরকারি সদস্য’ অর্থ কোনো মন্ত্রী ব্যতীত অন্য কোনো সদস্য; বিষয়টি তাৎপর্যপূর্ণ। সরকারের মন্ত্রিসভার সদস্য ছাড়া বাকি সব নির্বাচিত সংসদ সদস্যের দ্বারা যৌথভাবে সরকারে প্রতিপক্ষ হিসেবে ‘সংসদ’ গঠন করা হয়। সরকারি এবং বিরোধীদলীয় সব সংসদ সদস্য (মন্ত্রীরা বাদে) একক ও যৌথভাবে সরকারের প্রতিপক্ষ হিসেবে দায়িত্ব পালন করবেন, এটাই উদ্দেশ্য। সে ক্ষেত্রেই শুধু, সংসদ জনগণের কাছে সরকারের জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে পারে এবং সে প্রক্রিয়ায় ক্ষমতায় জনগণের মালিকানা প্রতিষ্ঠিত হয়। অর্থাৎ জনগণের শাসন প্রতিষ্ঠা বা গণতন্ত্রের চর্চা এভাবে সংসদ কার্যক্রমের মাধ্যমে বিকশিত হয়।

সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদ এখানে বাধাস্বরূপ কাজ করে। কেননা এ অনুচ্ছেদের বিধানের কারণে দলমতনির্বিশেষে সব সংসদ সদস্য সরকারের প্রতিপক্ষ হিসেবে সংসদে অবস্থান নিতে সক্ষম হয় না। সরকারি দলের সংসদ সদস্যরা সব বিষয়ে সরকারের পক্ষে অবস্থান নিতে বাধ্য থাকেন।

ব্রিটিশ পার্লামেন্টে সরকারি কোনো প্রস্তাবে সরকারদলীয় সব সদস্য একমত হবেন বা সমর্থন দেবেন এর কোনো বাধ্যবাধকতা নেই। ফলে সরকারি সব বিল সংসদে গৃহীত হবে এমন নিশ্চয়তা থাকে না। এমনকি সরকারের বিরুদ্ধে অনাস্থা প্রস্তাব আনয়ন করা হলে যদি সরকারি দলের কোনো কোনো সদস্য সমর্থন দেন (যার এখতিয়ার তাদের আছে) সরকারের পরিবর্তনও সম্ভব সংসদের মাধ্যমে।

আমাদের সংসদে, সংসদ সদস্যরা নিজেদের বিচার-বুদ্ধি-বিবেক বা এলাকার জনগণের রায়ের প্রতিফলনে তাদের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে পারেন না। তাদের সিদ্ধান্ত দলীয় নির্দেশের ওপর নির্ভরশীল। ফলে সরকারি প্রায় সব প্রস্তাব সংসদে দলীয় সংখ্যাগরিষ্ঠতার কারণে গৃহীত হয়, স্বাভাবিকভাবে।

বাংলাদেশের সংবিধানেও সরকারের বিরুদ্ধে অনাস্থা প্রস্তাব আনার বিধান আছে। সংবিধানে আছে প্রধানমন্ত্রী পদের মেয়াদ; ‘৫৭।(২) সংসদের সংখ্যাগরিষ্ঠ সদস্যের সমর্থন হারাইলে প্রধানমন্ত্রী পদত্যাগ করিবেন…’

গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ জাতীয় সংসদের কার্যপ্রণালি-বিধিতে এ-সংক্রান্ত বিধান নিম্নরূপ- ১৯তম অধ্যায়, মন্ত্রীদের বিরুদ্ধে অনাস্থা প্রস্তাব; অনুচ্ছেদ ১৫৯।(১) ‘এই বিধিসমূহ সাপেক্ষে, সচিবের বরাবরে অন্যূন তিন দিনের নোটিস প্রদান করিয়া যে কোন সদস্য গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের [মন্ত্রিসভার] বিরুদ্ধে আস্থাহীনতা জ্ঞাপন করিয়া প্রস্তাব উত্থাপনের অনুমতি প্রার্থনা করিতে পারেন।’

তবে সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদের কারণে সংসদের মাধ্যমে সরকার পরিবর্তনের দাবি বাস্তবায়ন প্রায় অসম্ভব।

বাস্তবতা হলো, আমাদের দেশে সরকারপ্রধান (যিনি প্রচলিত রীতি অনুযায়ী একই সঙ্গে সরকারি দলের এবং সরকারি সংসদীয় দলের প্রধান) যা কিছু সুপারিশ করেন বা অনুমোদন করেন সংসদে তা-ই গৃহীত হয়। সংবিধানে সরকারপ্রধানকে তার মেয়াদকালে নিজের বিচার-বুদ্ধি প্রয়োগ করে দেশ পরিচালনার দায়িত্ব ও তা পালনে একক ও সম্পূর্ণ কর্তৃত্ব দেওয়া হয়েছে। এখানে সংসদের ভূমিকা গৌণ বা পরামর্শক বা সহায়ক বলা যায়। সংসদ নিজ থেকে কোনো সিদ্ধান্ত গ্রহণে সক্ষম নয়। সরকারি সিদ্ধান্ত বা সুপারিশ অনুমোদন বা আইনসিদ্ধ করা সংসদের কাজ। সরকারি সিদ্ধান্ত বাতিল করার এখতিয়ারও সংসদের নেই। সে পরিপ্রেক্ষিতে সংসদকে প্রাণবন্ত ও কার্যকর করতে যা প্রয়োজন তা নিম্নরূপ-

ক) সংসদকে প্রাণবন্ত করতে দরকার গঠনমূলক আলোচনা, কোনো প্রস্তাব বা কর্মসূচির পক্ষে ও বিপক্ষে বিতর্ক। সে ক্ষেত্রে গুরুত্ব বহন করে বিরোধী দলকে তাদের বক্তব্য নিরপেক্ষভাবে তুলে ধরার সুযোগ ও পরিবেশ দেওয়া। সুযোগ দিতে পারেন সংসদের মাননীয় স্পিকার। পরিবেশ সৃষ্টি করতে হবে সরকারি দলকে। স্পিকার সময় দেবেন। সরকারি দল সমালোচনা গ্রহণ করবে। দোষ-ত্রুটির উল্লেখ বিদ্বেষমূলক কাজ বা শত্রুতা হিসেবে বিবেচনা করা হবে না, এ নিশ্চয়তা থাকতে হবে।

খ) সংসদ কার্যকর হবে, জনগণের আস্থার স্থান হবে, যখন সরকারি দল ও সরকার সমালোচনা বিবেচনা করবে। সুপারিশ মেনে নেবে, যদি সাধারণভাবে গ্রহণযোগ্য বিবেচিত হয়। এক কথায় সমালোচনা, তর্ক-বিতর্ক সংসদকে প্রাণবন্ত করে, সুপারিশ বিবেচনা ও সম্ভব হলে মেনে নেওয়া- সংসদকে কার্যকর করে।

অনেকেই মনে করেন, আমাদের দেশের আর্থ-সামাজিক পরিস্থিতিতে সংবিধান থেকে ৭০ অনুচ্ছেদ সম্পূর্ণভাবে বাদ দেওয়া বাস্তবসম্মত নয়। সে ক্ষেত্রে সরকারের সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়া ক্ষণে ক্ষণে বাধাগ্রস্ত হতে পারে। সরকারের স্থায়িত্বকাল অনিশ্চিত হওয়ার ও রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা বিঘিœত হওয়ার আশঙ্কা থাকে।

সে বিবেচনায়, ৭০ অনুচ্ছেদের প্রয়োগ শুধু তিনটি বিষয়ের মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখা যায়, যেমন- ১) সরকার গঠন, ২) বাজেট অনুমোদন এবং ৩) অনাস্থা প্রস্তাব।

এ তিনটি সময়ে ছাড়া বাকি সব বিল/প্রস্তাব পাসের সময় সংসদ সদস্যরা (বিশেষ করে সরকারদলীয়) যদি স্বাধীনভাবে সংসদে সিদ্ধান্ত বা ভোট দিতে পারেন, তবে কিছুটা হলেও সংসদ অধিকতর ক্ষমতাশালী হতে পারে। এতে সরকার গঠন ও মেয়াদকালের শেষ পর্যন্ত সে সরকারের দায়িত্ব পালন বিঘিœত হওয়ার সম্ভাবনা রোধ হবে। সরকারের স্থায়িত্ব ও রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা নিশ্চিত হবে।

একই সঙ্গে, অন্য সব ক্ষেত্রে, সংসদ সদস্যদের জন্য নিজস্ব বিবেক-বুদ্ধি ও নির্বাচনী এলাকার মানুষের মতামতের প্রতিফলন অনুযায়ী সংসদে সিদ্ধান্ত দেওয়ার ক্ষেত্রে কোনো বাধা থাকবে না।

শাসনব্যবস্থায় এ সংস্কার প্রস্তাব দেশের জনগণকে প্রকৃত সংসদীয় পদ্ধতির সরকারব্যবস্থার স্বাদ গ্রহণের কিছুটা হলেও সুযোগ করে দেবে।         

লেখক : চেয়ারম্যান, জাতীয় পার্টি।