bd-pradin

প্রকাশ : ০৫ সেপ্টেম্বর, ২০১৫ ০০:০০:০০আপডেট : ০৫ সেপ্টেম্বর, ২০১৫ ০০:০

গোলাম মোহাম্মদ কাদের

একটি চা কোম্পানির বিপণন বিজ্ঞাপন, ‘কাপ শেষ তবু চায়ের রেশ থেকেই যায়’। অনেক সমালোচকের মতে, কথাটার সঙ্গে বাংলাদেশের বিদ্যমান গণতন্ত্রের মিল খুঁজে পাওয়া যায়। তাদের মন্তব্য দেশে গণতন্ত্রের লেশ খুঁজে পাওয়া যায় না। তবে সরকারি দলের কথাবার্তায় মনে হয় এখনো গণতন্ত্রের রেশ রয়ে গেছে। ৫ জানুয়ারি ২০১৪ সালের নির্বাচন বিভিন্ন কারণে প্রশ্নবিদ্ধ। দেশের বৃহৎ জনগোষ্ঠীর অভিমত, একতরফা নির্বাচনের মাধ্যমে মোটামুটি একদলীয় সংসদ গঠন করা হয়েছে।
একনায়কতন্ত্র অর্থ এক ব্যক্তি বা সরকারপ্রধানের এককভাবে দেশ শাসন। তিনি শুধু নির্বাহী বিভাগের প্রধান থাকেন না প্রজাতন্ত্রের নির্বাহী বিভাগের জবাবদিহিতার জন্য সৃষ্ট অন্য প্রতিষ্ঠানগুলোর নিয়ন্ত্রণ তার কর্তৃত্বাধীন থাকে। ফলে তিনি জবাবদিহিতার ঊর্ধ্বে অবস্থান নেন এবং জবাবদিহিতাবিহীনভাবে কার্যক্রম পরিচালনায় সক্ষম হন। নির্বাচন কমিশন নিয়ন্ত্রণে থাকার কারণে নির্বাচনের ফলাফল ইচ্ছামাফিক প্রস্তুত করার এবং এ প্রক্রিয়ায় চিরস্থায়ীভাবে ক্ষমতা দখলে রাখার সুযোগ থাকে।
সংসদীয় পদ্ধতিতে সরকার ও সরকারপ্রধানের জবাবদিহিতার গুরুদায়িত্ব থাকে সংসদের ওপর। বর্তমান সংসদের অধিকাংশ সদস্য সরকারি দলের অন্তর্ভুক্ত। একটি ক্ষুদ্রাকৃতির বিরোধী দল দাফতরিকভাবে ঘোষণা দিয়ে গঠন করা হয়েছে। সেই দল থেকে কয়েকজনকে মন্ত্রিসভার সদস্য নিয়োগ করে একই সঙ্গে তাদের সরকারের অংশীদারিত্ব দেওয়া হয়েছে। বাংলাদেশ সংবিধানের ৭০ ধারা মোতাবেক দলীয় সংসদ সদস্যরা কোনো ক্ষেত্রেই দল ভেঙে ভিন্ন প্লাটফরমে যেতে পারেন না। তাদের সবাইকে সার্বিকভাবে এক পক্ষে থাকতে হবে। কেউ বিপক্ষে অবস্থান নিলে সংসদ সদস্য পদ হারাবেন। ফলে বর্ণিত বিরোধী দল মন্ত্রিপরিষদের অংশ হওয়ায় সরকারবিরোধী অবস্থান নিতে পারবে না, নিলে সে দলের মন্ত্রীরা সংসদ সদস্য পদ হারাবেন। বিরোধী দল হলেও বাস্তবে মন্ত্রিপরিষদের অংশ হয়ে সরকারবিরোধী অবস্থানে যাওয়ার সুযোগ নেই। জানা যায়, উক্ত বিরোধী দল এখন পর্যন্ত সরকারের কোনো প্রস্তাবে দ্বিমত পোষণ করে সংসদে ‘না’ ভোট দেয়নি। ফলে তাদের পরিচয় সরকার সমর্থক বিরোধী দল বা ‘অসুস্থ স্বাস্থ্যবান মানুষ’ এ ধরনের একটি গোঁজামিল। সমালোচকদের বক্তব্য, সংসদ বাস্তবে বিরোধী দলবিহীন ও সরকারের জবাবদিহিতা গ্রহণে অকার্যকর।
বর্তমানে সরকারপ্রধান সরকারি দলের প্রধান, একই সঙ্গে সংসদীয় দলেরও প্রধান। তার সিদ্ধান্ত দলীয় সংসদ সদস্যদের জন্য অবশ্যপালনীয়। আগেই বলা হয়েছে, সাংবিধানিক বাধার কারণে সংসদ সদস্যরা কোনো ক্ষেত্রেই দল ভেঙে ভিন্নমত প্রদর্শন করতে পারেন না। বর্তমান সংসদে সরকারদলীয় সংসদ সদস্যের সংখ্যা শুধু সংখ্যাগরিষ্ঠ নয়, নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠ। ফলে সংখ্যাগরিষ্ঠ ভোট অথবা দুই-তৃতীয়াংশ ভোটে অনুমোদনযোগ্য যে কোনো প্রস্তাব সংসদে পাস করানো সম্ভব। এ বিষয়ে নির্দেশ দেওয়ার একক ক্ষমতাধারী ব্যক্তি সরকারপ্রধান বা প্রধানমন্ত্রী। ফলে সংসদের সব কার্যক্রম ও সিদ্ধান্ত সরকারপ্রধানের প্রত্যক্ষ নিয়ন্ত্রণে বলা যায়।
এখানে উল্লেখ্য, সংসদে স্পিকার, ডেপুটি স্পিকার ইত্যাদি পদ সংসদ সদস্যদের সংখ্যাগরিষ্ঠ ভোটে নির্বাচিত ও অপসারিত হওয়ার বিধান আছে। সে অর্থে স্পিকার পদগুলোর নিয়োগ ও অপসারণ সরকারপ্রধানের সিদ্ধান্তের ওপর নির্ভরশীল। রাষ্ট্রপতি নিয়োগ সংসদের সংখ্যাগরিষ্ঠ সদস্যদের অনুমোদনে হয়। তার অপসারণে দুই-তৃতীয়াংশ সমর্থনের প্রয়োজন হয়। ফলে রাষ্ট্রীয় সর্বোচ্চ এ গুরুত্বপূর্ণ পদটি নিয়োগ ও বরখাস্ত করার এখতিয়ার বর্তমান পরিস্থিতিতে সংসদের মাধ্যমে সরকারপ্রধানের নাগালের ভিতর। তার যে কোনো কাজ এমনকি নিজস্ব এখতিয়ারভুক্ত সিদ্ধান্ত গ্রহণে মহামান্য রাষ্ট্রপতি সরকারপ্রধানের ইচ্ছা-অনিচ্ছার প্রভাব অনুভব করবেন, এ সম্ভাবনা থেকেই যায়।
প্রধান বিচারপতির নিয়োগ রাষ্ট্রপতির এখতিয়ারভুক্ত। প্রধান বিচারপতির অপসারণও বর্তমানে রাষ্ট্রপতির ন্যায় একই প্রক্রিয়ায় সংসদের হাতে ন্যস্ত। প্রধান বিচারপতির নিয়োগ ও অপসারণ উপরোক্ত কারণে প্রভাবিত করার পরোক্ষ পন্থা সরকারপ্রধানের আওতাভুক্ত। উচ্চ আদালতের অন্য বিচারপতিদের নিয়োগ প্রধান বিচারপতির সুপারিশসহ রাষ্ট্রপতির অনুমোদনে কার্যকর হয়। বিচারপতিদের অপসারণও প্রধান বিচারপতির ন্যায় সংসদের হাতে ন্যস্ত। ফলে বর্তমান পরিস্থিতিতে এসব বিষয় সরকারপ্রধানের নাগালের আওতাবহিভর্ূত নয় বললে অত্যুক্তি হয় না।
নির্বাচন কমিশন, মানবাধিকার কমিশন, দুর্নীতি দমন কমিশন, তথ্য কমিশন ইত্যাদি সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানের নিয়োগে সরকারপ্রধানের মতামতের প্রতিফলন হওয়ার সুযোগ আছে। সংবিধান সংশোধন করে তাদের অপসারণও সংসদের এখতিয়ারে আনা হয়েছে, যার প্রকৃত অর্থ বর্তমান প্রেক্ষাপটে সরকারপ্রধানের নাগালের সীমারেখার ভিতরে।
৫ জানুয়ারির (২০১৪) নির্বাচন ও তার পরবর্তীতে এ পর্যন্ত যত নির্বাচন হয়েছে সেগুলোর কার্যক্রমে নির্বাচন কমিশনের নিরপেক্ষতা ও উপযুক্ততা সম্পর্কে ব্যাপক আস্থাহীনতা লক্ষ্য করা যায়। তাদের সব কাজে সরকারি দলের বা সরকারপ্রধানের ইচ্ছার প্রতিফলন হচ্ছে বলে মানুষের ধারণা। একই কথা দুর্নীতি দমন কমিশনসহ অন্যান্য সাংবিধানিক পদের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য বলা যায়।
সরকারপ্রধান বা প্রধানমন্ত্রী বর্তমানে শুধু নির্বাহী বিভাগের প্রধান নন, একই সঙ্গে পরোক্ষভাবে হলেও রাষ্ট্রের আর সব প্রতিষ্ঠান তার প্রভাব বলয়ের আওতায়। এক ব্যক্তির পক্ষে যখন রাষ্ট্র পরিচালনার সব প্রতিষ্ঠানকে নিয়ন্ত্রণ করার সুযোগ থাকে তখন যে শাসন প্রক্রিয়া চলে তাকে বলা যায় একনায়কতন্ত্র। একনায়কতন্ত্রের অবস্থান গণতন্ত্রের বিপরীত মেরুতে।
আগেই বলা হয়েছে, একনায়করা ক্ষমতা ব্যবহারে জবাবদিহিতার ঊর্ধ্বে থাকেন ও নির্বাচন কমিশন নিয়ন্ত্রণ করে ক্ষমতার দখল চিরস্থায়ী করতে পারেন। ঐতিহাসিকভাবে দেখা যায়, একনায়করা স্বৈরাচারী হয়ে ওঠেন। ফলে প্রজাতন্ত্র স্বৈরতন্ত্রে রূপান্তরিত হয়। স্বৈরশাসক যখন তার উত্তরাধিকার পরিবারের সদস্যদের মধ্যে ঠিক করার রেওয়াজ রাষ্ট্রীয় সাংবিধানিক কাঠামোতে অন্তর্ভুক্ত করেন তখন আনুষ্ঠানিকভাবে রাজতন্ত্রের সৃষ্টি হয়। অন্য সব বিষয় স্বৈরতন্ত্র ও রাজতন্ত্র সমার্থক বলা যায়।
‘Power corrupts, absolute power corrupts absolutely’ ক্ষমতা দুর্নীতির সৃষ্টি করে, সর্বময় ক্ষমতা সামগ্রিকভাবে দুর্নীতিগ্রস্ত করে। এ তত্ত্বকথাটি ইতিহাস ও অভিজ্ঞতার আলোকে প্রমাণিত। ফলে স্বৈরাচারী শাসন সুশাসনের কবর রচনা করে, দুঃশাসনের জন্ম দেয়। দুর্নীতির অপ্রতিরোধ্য বিস্তার হতে থাকে, মানুষের অধিকার হরণ ও লঙ্ঘন ঘটে, সামাজিক ন্যায়বিচার তিরোহিত হয়। ধনী-দরিদ্রের বিভেদ তীব্র থেকে তীব্রতর হয়, নিরাপত্তাহীনতা, বঞ্চনা, অন্যায়, অবিচার, হতাশা সাধারণ মানুষের সার্বক্ষণিক সঙ্গী হয়।
বর্তমান বিশ্বে গণমাধ্যমের প্রভূত উন্নতি ও বিস্তার সাধিত হয়েছে। ফলে সরকারের কাজকর্ম, সমাজে বিচারহীনতা, জনগণের কষ্ট, ক্ষয়ক্ষতি ও প্রতিক্রিয়া খুব অল্প সময়ে জানাজানি হয়ে যায়। গণতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থায় গণমাধ্যমসমূহকে শাসকদের জন্য সংশোধন করার সুযোগ ও সে হিসেবে সহায়ক প্রতিষ্ঠান হিসেবে গণ্য করা হয়। বর্তমানে বাংলাদেশে গণমাধ্যমের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিবর্গ, কর্মী ও মালিকরা এ বিষয়ে বস্তুনিষ্ঠ বাস্তবতা জানাতে পারবেন। তবে অতি সম্প্রতি জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান ও সাবেক রাষ্ট্রপতি এরশাদ গণমাধ্যম সম্পর্কে কিছু মন্তব্য করেছেন। সেখানে তিনি বলেছেন, বর্তমানে দেশে গণমাধ্যমের স্বাধীনতা সংকুচিত করা হয়েছে। (দি ডেইলি স্টার, ২৭ আগস্ট, ২০১৫)।
স্বৈরশাসনে শান্তিপূর্ণ উপায়ে ক্ষমতা পরিবর্তনের সুযোগের অভাব থাকে। ফলে রাজনীতির স্বাভাবিক ধারা ব্যাহত হয়, সামাজিক অস্থিরতা বৃদ্ধি পায়। অর্থনীতির গতি শ্লথ হয়, উন্নয়নের ধারা ক্ষতিগ্রস্ত হয়। অনিয়মতান্ত্রিক বা হিংসাত্দক পথে ক্ষমতা পরিবর্তনের তাগিদ সৃষ্টি হয়। চরমপন্থি সন্ত্রাসী, জঙ্গি রাজনীতির উত্থান হওয়ার সম্ভাবনা দেখা দেয়।
বর্তমানে দেশে কিছু কিছু কর্মকাণ্ড পরিলক্ষিত হচ্ছে যা ইসলামী জঙ্গি সংগঠনের বলে দাবি করা হচ্ছে। ওই কাজগুলো তাদের বলে ধরে নিলেও বিশ্বের বিভিন্ন জায়গায় জঙ্গি কর্মকাণ্ডের তুলনায় আপেক্ষিকভাবে আমাদের দেশে জঙ্গিদের সাংগঠনিক অবস্থান একেবারেই শিশু পর্যায়ে বলা যায়। যতটুকুই আছে সে বিষয়ে সরকারি তরফ থেকে নির্মূল করার যত শক্ত কথা বলা হয়, কাজে ততটা তৎপর কি না, সে বিষয়ে অনেকেই সন্দেহ পোষণ করে থাকেন।
তবে সমাজে দুর্নীতি, বিচারহীনতা, দারিদ্র্য ও নিরাপত্তার অভাব থাকলে তা জঙ্গিবাদকে এগিয়ে নিয়ে যাবে। সে ক্ষেত্রে এ সমস্যা শুধু বাংলাদেশকে পশ্চাৎপদ করবে তাই নয়, প্রতিবেশী দেশসমূহসহ অনেক দেশের নিরীহ জনগণের জন্য নিরাপত্তার হুমকি হতে পারে। দেশ যাতে যে কোনো ধরনের একনায়কতন্ত্রের ধারা থেকে গণতন্ত্রের পথে, স্বৈরতন্ত্র নয় প্রজাতন্ত্রের পথে অগ্রসর হয় সেদিকে সবার দৃষ্টি দেওয়া আবশ্যক। কেননা এটাই এক অর্থে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও স্বাধীনতার আসল উদ্দেশ্য।
বর্তমান ক্ষমতাসীন দল বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে নেতৃত্ব দিয়েছে। জনগণের ক্ষমতা পুনরুদ্ধারে অতীতে বিভিন্ন সময় এ দলের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল। স্বাধীনতাকালে এ দলের প্রধান পরবর্তীতে জাতির জনক হিসেবে স্বীকৃত হয়েছেন। দেশে এখন যে পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে তা থেকে বেরিয়ে আসার জন্য সে দল ও দলের নেতাকে সহায়তার হাত নিয়ে এগিয়ে আসতে হবে, এটাই দেশবাসীর প্রত্যাশা।

লেখক : সাবেক মন্ত্রী ও প্রেসিডিয়াম সদস্য, জাতীয় পার্টি