বাংলাদেশ প্রতিদিন
প্রকাশ : রবিবার, ২৬ জুন, ২০১৬ ০০:০০ টা
গোলাম মোহাম্মদ কাদের
চরমপন্থি রাজনীতি শুরু হয় সাধারণত সমাজ জীবনে বিরাজমান হতাশা থেকে। যখন মানুষ নানা কারণে নিজেদের বঞ্চনা, বৈষম্য, নির্যাতনের শিকার মনে করে; সে বিষয়গুলো প্রকাশের বা প্রকাশ করলেও নিরসনের ব্যবস্থা দেখে না; স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় সামাজিক ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠায় প্রয়োজনীয় পরিবর্তন হওয়ার বিষয়ে আস্থা হারায়; তখন উগ্রবাদ মাথাচাড়া দেয়। সরকার বা কর্তৃপক্ষের ওপর আঘাত হানতে ও অনিয়মতান্ত্রিকভাবে পরিবর্তনের জন্য আগ্রহ সৃষ্টি হয়; সন্ত্রাসবাদই একমাত্র পথ হিসেবে বিবেচিত হয়। উগ্র রাজনীতির দুটি ধারা বিদ্যমান একটি Ultra Left (উগ্র বামপন্থি) অন্যটি Ultra Right (উগ্র ডানপন্থি)। স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশে Ultra Left উগ্র রাজনীতির বিকাশ লক্ষ্য করা গেছে। বর্তমানে Ultra Right বা ধর্মভিত্তিক উগ্রবাদ লক্ষ্য করা যাচ্ছে। এ মতাদর্শীরা তাদের ধারণার ইসলাম ধর্মকে আদর্শের ভিত্তি হিসেবে গ্রহণ করে। সে আদর্শ বাস্তবায়নে সন্ত্রাসসহ আইন-বহির্ভূত হিংসাত্মক কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে সমাজ জীবনে অস্থিরতার সৃষ্টি করে। নিজেদের আদর্শ প্রসূত কর্মসূচির মাধ্যমে সরকারকে বিব্রত, অকার্যকর ও অস্থিতিশীল করার উদ্যোগ নেয়। সমাজ পরিবর্তনের প্রচেষ্টা চালায়। ইসলাম ধর্মকে অপব্যবহার করে এ ধরনের উগ্র ডানপন্থি রাজনীতিকে জঙ্গিবাদ হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়। দেশের জনসংখ্যার যত বেশি সংখ্যক নাগরিকের সহানুভূতি বা সমর্থন লাভ করতে পারে তত বেশি মাত্রায় তাদের সাফল্য অর্জিত হয়। সাধারণ মানুষের মধ্য থেকে তাদের অভিযানসমূহ সংঘটিত করা ও ব্যক্তিবর্গকে দলভুক্ত করার সুবিধা থাকে। সমর্থকদের সাহায্য ও পৃষ্ঠপোষকতা এ ধরনের সংগঠনের জন্য অত্যন্ত জরুরি। তথাকথিত ইসলাম ধর্মভিত্তিক উগ্র ডানপন্থি রাজনীতির বিপজ্জনক দিক হলো, এটি এখন সারা বিশ্বে বিভিন্নভাবে ছড়িয়ে পড়ছে। জঙ্গিবাদ বর্তমানে একটি আন্তর্জাতিক সমস্যা। বিশ্বের বিভিন্ন স্থান থেকে সাহায্য-সহযোগিতা, এমনকি অস্ত্রশস্ত্র ও জঙ্গি যোদ্ধারা এ ধরনের যুদ্ধে যোগ দেওয়ার জন্য সংগ্রামরত দেশগুলোতে পাড়ি জমাচ্ছে। পৃথিবীর যে সব মুসলমান অধ্যুষিত দেশে জঙ্গিবাদের উত্থান হয়েছে যেমন— ইরাক, লিবিয়া, সিরিয়া, নাইজেরিয়া ইত্যাদি, এ সব দেশে দেখা যায়, গণতন্ত্রের অভাব, ফলে জবাবদিহিতাহীন সরকার ব্যবস্থা। যার ফলশ্রুতিতে অন্যায়-অবিচার, জুলুম-নির্যাতন, দুর্নীতি-বৈষম্য ব্যাপক। ন্যায়বিচার ভিত্তিক সমাজ ব্যবস্থার উপাদানসমূহে এ সব দেশে ব্যাপক ঘাটতি পরীলক্ষিত হয়। বিক্ষুব্ধ মানুষ ক্ষোভ, হতাশা ও অনিশ্চয়তায় দিনাতিপাত করে। এ পরিস্থিতিতে জঙ্গিবাদের পৃষ্ঠপোষক ও সমর্থক তৈরি হয় প্রচুর পরিমাণে। ফলে জঙ্গিবাদ মাথাচাড়া দেয় সহজে। বাংলাদেশের পরিস্থিতিতে জঙ্গিবাদ সৃষ্টির উপরোক্ত উপাদানসমূহ ক্রমবিকাশমান বলা যায়। ফলে স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় জঙ্গিবাদের সৃষ্টি ও প্রসার হওয়ার আশঙ্কাও প্রচুর। শুধু শক্তি প্রদর্শন ও অস্ত্রের ব্যবহারে এ কারণসমূহ দূরীভূত হবে না। যত বেশি জঙ্গিকে হত্যা করা হবে, বিশেষ করে অস্বাভাবিক পদ্ধতিতে বা সাধারণ মানুষ জঙ্গি সংশ্লিষ্টতার অজুহাতে হয়রানির স্বীকার হবে তত মানুষের কাছে অবিচার, অত্যাচার, নির্যাতন বেশি করে অনুভূত হবে। নতুন নতুন জঙ্গি ও সমর্থক সৃষ্টির পরিবেশ সম্প্রসারিত হবে। এ প্রক্রিয়ায় সাধারণত জঙ্গিবাদ নির্মূল না হয়ে বরং সবল হওয়ার আশঙ্কা থাকে। এখানে উল্লেখ্য, বাংলাদেশের সন্ত্রাসবাদের উত্থানের কারণ বিশ্লেষণে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অ্যাম্বাসেডর মাইলাম, যিনি আশির দশকের শেষ থেকে নব্বই দশকের প্রথম পর্যন্ত দীর্ঘদিন বাংলাদেশে কাটিয়েছেন, তিনি ১৯ মে, দি নিউইয়র্ক টাইমস পত্রিকায় ‘The Real Source of Terror in Bangladesh’ শিরোনামে লিখেছেন, ‘বাংলাদেশে সংঘটিত সাম্প্রতিককালের নৃশংস হত্যাকাণ্ডসমূহ সন্ত্রাসবাদের চেয়ে অধিক পরিমাণ শাসনের সমস্যা। ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ বিগত ২০১৪ সালের জানুয়ারির নির্বাচনের পর থেকে তার রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের ওপর ব্যাপকহারে যে নির্যাতনমূলক কার্যকলাপ শুরু করেছে সেটাই বাংলাদেশে চরমপন্থা সক্রিয় হওয়ার ক্ষেত্র প্রস্তুত করেছে।’ (The recent string of vicious killings in Bangladesh is less a terrorism issue than a governance issue: It is the ruling Awami League’s onslaught against its political opponents which began in earnest after the last election in January 2014, that has unleashed extremists in Bangladesh) উনি তার মতামতের উপসংহার শেষ করেছেন এই বলে, ‘একের পর এক এই ধরনের সন্ত্রাসী আক্রমণকে ‘শাসন’জনিত সমস্যা না বিবেচনায় এনে, প্রধানত ‘নিরাপত্তার’ বিষয় হিসেবে ব্যবস্থা নেওয়া হলে, তা পরিস্থিতির আরও অবনতি ঘটাবে।’ (Responding to this wave of attacks as though it ware principally a security issue, rather than a governance problem, would only make matters worse’) বাংলাদেশের বর্তমান চরমপন্থি সন্ত্রাসী কার্যকলাপ সম্পর্কে সরকার-সরকারি দলের ভাষ্য হলো এটা তাদের রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ বিএনপি-জামায়াতের কাজ। দেশকে অস্থিতিশীল করে শাসন ক্ষমতা দখলের জন্য এটা করা হচ্ছে। অপরদিকে বিএনপির তরফ থেকে বলা হচ্ছে, সরকার ও সরকারি দল এর সঙ্গে জড়িত। বিএনপির নেতা-কর্মীদের খুন, গুম, নির্যাতন, মামলা করার ক্ষেত্র প্রস্তুতের জন্য সরকার-সরকারি দলের মদদে এসব কর্মকাণ্ড সংঘটিত হচ্ছে। দুই ধরনের দাবির পক্ষেই কিছু যুক্তি দেখানো হচ্ছে। শুরুটা যেভাবেই হোক, দেশের অধিকাংশ মানুষ মনে করে জঙ্গি সন্ত্রাস কর্মকাণ্ডগুলো সরকারকে বিপাকে ফেলেছে। সরকারি দলের রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ দলসমূহ ও জনগণের একটি উল্লেখযোগ্য অংশ দাবি করে তারা বিভিন্নভাবে সরকারি নির্যাতনে অতিষ্ঠ। ফলে তারা সরকারকে পছন্দ করবে না এটাই স্বাভাবিক। জঙ্গি সন্ত্রাসী ঘটনায় সরকার বিপাকে পড়লে এ কারণে তারা অখুশি নন, ধরে নেওয়া যায়। ফলে দেশের উল্লেখযোগ্য রাজনৈতিক শক্তি এবং জনগণের একটি অংশ যারা সাধারণভাবে হয়তো জঙ্গি সন্ত্রাস পছন্দ করে না তারাও বর্তমান প্রেক্ষাপটে জঙ্গিদের প্রতি সহানুভূতিশীল হতে পারে। সরকার জঙ্গি দমনে যত বেশি ঢালাওভাবে রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ ও সাধারণ জনগণের ওপর কঠোর শক্তি প্রয়োগ চালিয়ে যাবে এ ধরনের সমর্থকের সংখ্যা ততই বাড়তে থাকবে আশঙ্ক্ষা হয়। এ ক্ষেত্রে শুধু বিএনপি-জামায়াত নয়, সরকারি দল ও জোটের সদস্যরাও যারা নানাভাবে বঞ্চিত, কিছু কিছু ক্ষেত্রে নির্যাতিত মনে করে তারাও সমর্থকদের দলে শরিক হতে পারে। সরকারের পক্ষে প্রতিপক্ষ রাজনৈতিক দল ও তাদের নেতা-কর্মীদের জঙ্গিবাদ সংশ্লিষ্টতার কারণে বা সন্দেহে শক্তি প্রয়োগে নির্জীব করা হয়তোবা সম্ভব হতেও পারে। কিন্তু তাদের সমর্থক গোষ্ঠীকে যারা দেশের উল্লেখযোগ্য জনসমষ্টি তাদের নিষ্ক্রিয় করা সহজসাধ্য কাজ নয়। এ ধরনের প্রচেষ্টার এক পর্যায়ে সরকারবিরোধী বা সরকারি দল যার মদদেই শুরু হোক, মদদ ছাড়াই শুধু জনসমর্থনের ভিত্তিতে ও সাধারণ জনগণের পৃষ্ঠপোষকতায় জঙ্গিবাদ দাঁড়িয়ে যেতে পারে, এ আশঙ্কা আছে। সে ক্ষেত্রে, আন্তর্জাতিক জঙ্গি সংগঠনগুলো সাহায্যের হাত বাড়িয়ে আমাদের দেশের সমস্যাকে আরও জটিলতর ও ভয়াবহ করবে না তার নিশ্চয়তা কি? আগেই বলা হয়েছে, আমাদের মতো মুসলিম প্রধান, ধর্মভীরু, দারিদ্র্যপীড়িত, দুর্নীতিগ্রস্ত, বৈষম্যপূর্ণ জনসংখ্যা বহুল দেশে জঙ্গিবাদ সৃষ্টির ও গেড়ে বসার অনুকূল পরিবেশ ও আবহাওয়া এমনিতেই বিদ্যমান। জঙ্গিবাদের কার্যকলাপে দেশের সাধারণ মানুষ যেন প্রচ্ছন্নভাবে হলেও তৃপ্তি লাভ না করে সে বিষয়টি গুরুত্ব দিয়ে বিবেচনা করতে হবে। জনগণের ক্ষোভ-হতাশাকে উপেক্ষা না করে এর কারণসমূহ আন্তরিকভাবে চিহ্নিত করতে হবে। সরকারকে যতটা সম্ভব দৃশ্যতভাবে এ সমস্যাগুলো নিরসনের উদ্যোগ নিতে হবে, যাতে জনগণ সরকারের সদিচ্ছার ওপর আস্থা রাখতে ও নির্ভরশীল হতে পারে। তাহলেই মানুষ জঙ্গি কার্যকলাপের বিরুদ্ধে অবস্থান নেবে আশা করা যায়। সুশাসনের মাধ্যমে ন্যায়বিচার ভিত্তিক সমাজ ব্যবস্থা সৃষ্টির মধ্য দিয়েই শুধু মানুষের মধ্যে হতাশা, ক্ষোভ ও মরিয়াভাব দূর করা সম্ভব। সঠিকভাবে গণতন্ত্রের চর্চা সর্বস্তরে জবাবদিহিতা সৃষ্টির মাধ্যমে সুশাসন নিশ্চিত করে। জঙ্গি ও সন্ত্রাসবাদ দমনে সে ধরনের গণতন্ত্র চর্চার ব্যবস্থা নিতে হবে। এ উদ্দেশ্য বাস্তবায়নে এর চেয়ে সহজ ও শান্তিপূর্ণ আর কোনো বিকল্প নেই।