জনগণের স্বার্থে ও দেশের কল্যাণে যে কোনো ধরনের পরিবর্তনের সঙ্গে জাতীয় পার্টি (জাপা) থাকবে বলে জানালেন দলটির চেয়ারম্যান জি এম কাদের। তিনি বলেছেন, গণতন্ত্র মানে জনগণের তন্ত্র। জনগণ যেভাবে চাইবে, অর্থাত্ জনগণের ইচ্ছার প্রতিফলনের সঙ্গেই জাপা থাকবে। কারণ জনগণ কখনো খারাপ কিছু প্রত্যাশা করে না। এ কথাও সত্য, পৃথিবীতে যতগুলো বড় পরিবর্তন ঘটেছে, কোনোটিই সাংবিধানিক পন্থায় হয়নি। গত মঙ্গলবার তিনি তার উত্তরার বাসায় সমসাময়িক রাজনীতি, চলমান প্রেক্ষাপটসহ বিভিন্ন বিষয়ে ইত্তেফাকের এই প্রতিনিধিসহ একাধিক সাংবাদিকের সঙ্গে আলাপকালে এ কথা বলেন।জাপা চেয়ারম্যানের মতে, দেশের রাজনীতি ও প্রতিষ্ঠানগুলো যদি নিয়মতান্ত্রিকভাবে পরিচালিত না হয়; তাহলে সেখানে অনিয়মতান্ত্রিক শক্তির উত্থান ঘটে, এটা স্বাভাবিক। স্বাভাবিক রাজনৈতিক প্রক্রিয়া বাধাগ্রস্ত হলে চরমপন্থা, বিশেষ করে আইনসিদ্ধ নয় এমন সংগঠনগুলো মাথাচাড়া দিয়ে উঠতে পারে। রাজনৈতিক শূন্যতার সুযোগে এই শক্তি বড় কোনো অঘটনও ঘটাতে পারে, যা কোনো গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক দল ও সাধারণ মানুষ কামনা করে না।এক প্রশ্নের জবাবে জি এম কাদের বলেন, রাজনীতি আস্তে আস্তে হারিয়ে যাচ্ছে। দেশে ৪০টির মতো নিবন্ধিত রাজনৈতিক দল থাকলেও কয়েকটি ছাড়া বাকিগুলো চোখে পড়ছে না। দিনে দিনে মানুষ রাজনীতি থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ছে। দেশ রাজনীতিমুক্ত ও রাজনৈতিক দলশূন্য হয়ে পড়ার মতো পরিস্থিতি দেখা যাচ্ছে। অবাধ, সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের আশা ছেড়ে দিচ্ছে মানুষ। দেশে যে নির্বাচনগুলো হয় কিংবা হচ্ছে, সেগুলো জনগণের কাছে বিশ্বাসযোগ্য হচ্ছে না।রাজনীতি আস্তে আস্তে হারিয়ে যাচ্ছে—এমনটি আপনার মনে হওয়ার কারণ কী? জাপার চেয়ারম্যানের ব্যাখ্যা, দেশে বর্তমানে রাজনৈতিক যে পরিবেশ, সেখানে অনেক সময় কাজ করা সম্ভব হচ্ছে না। বিরোধী দলগুলোর নেতৃত্ব নিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যে কথা বলেছেন, সেটি বিশ্লেষণ করলেও মূলত আমি দেখি শুধু পরিবেশগত পার্থক্য। নেতৃত্ব আগে যেমন ছিল, এখনো তেমনই আছে।‘পরিবেশগত পার্থক্য’ সম্পর্কে বিস্তারিত জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘আগে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে একধরনের সৌহার্দপূর্ণ সম্পর্ক ছিল, বিরোধী দলগুলোর প্রতি সরকার অনেক বেশি সহনশীল ছিল। দলগুলো যার যার ভাব-আদর্শ নিয়ে কর্মসূচি পালন করতে পারত। কর্মসূচি পালনে কখনো কখনো সমস্যার সম্মুখীন হলেও সেটি এখনকার মতো এই মাত্রায় ছিল না। সেজন্য বলছি, সহনশীলতার ঘাটতি আগের তুলনায় এখন প্রবল।’প্রধান প্রধান দলগুলোর নেতৃত্ব বিশ্লেষণে জি এম কাদের বলেন, দেশের সামন্তবাদী চরিত্রের কারণে এখানে ব্যক্তিকেন্দ্রিক রাজনীতি প্রাধান্য পায়। যিনি নেতৃত্ব দেন, তার ওপরই ঐ দলের পুরো রাজনীতি নির্ভরশীল। বিএনপির নেত্রী সাজা খাটছেন, মুচলেকা দিয়ে তিনি কার্যত রাজনীতির বাইরে চলে গেছেন। ফলে বিএনপি নেতৃত্বের সংকটে ভুগছে। বিএনপির দ্বিতীয় নেতৃত্ব বেগম জিয়ার ছেলে (তারেক রহমান) দেশে থেকে রাজনীতি করতে পারছেন না, তিনিও দণ্ডিত। নেতৃত্বহীনতার কারণে দলটি বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই সিদ্ধান্তহীনতায় থাকে, যার কারণে এগোতে পারছে না। আর আওয়ামী লীগের সভানেত্রী শেখ হাসিনা এমন স্তরে পৌঁছেছেন, যেখানে দলের অন্য কেউ তার কছাকাছি নেই। সেক্ষেত্রে নেতৃত্বের ঘাটতি হলে দলটিতে ব্যাপক প্রভাব পড়বে।এইচ এম এরশাদের অবর্তমানে জাপার নেতৃত্ব সম্পর্কে কী বলবেন? জবাবে প্রয়াত এরশাদের সহোদর বলেন, ‘এরশাদ যখন ছিলেন, তখন বিষয়টা ছিল—জাপা মানে এরশাদ, এরশাদ মানে জাপা; উনি যেটা বলতেন সেটিই দলের রাজনীতি, সেটিই দলের সিদ্ধান্ত ছিল। তার অবর্তমানে এখন জাপায় সেই ভাবমূর্তি এককভাবে আমাদের কারো নেই। আমরা এখন দলের ঐক্য ও শক্তিটাকে টিকিয়ে রাখার চেষ্টা করছি। সবাই আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নিই, আমরা মনে করছি, এরশাদের অবর্তমানে ঐক্যটাই আমাদের একমাত্র শক্তি।’আপনি নিজেও সম্প্রতি বলেছেন, জাপাকে মানুষ আওয়ামী লীগ মনে করে। কারণ কী? জি এম কাদেরের জবাব, ’৯১ থেকে বেশির ভাগ সময়ই জাপা কোনো না কোনোভাবে আওয়ামী লীগের সঙ্গে সখ্য গড়েছে। সেই কারণে মানুষ মনে করে, জাপা আওয়ামী লীগ হয়ে গেছে। কিন্তু বিষয়টা তা নয়। ’৯৬-এ জাপার সমর্থন ছাড়া আওয়ামী লীগ সরকার গঠন করতে পারছিল না। সেজন্য জাপাকে সঙ্গে নিতে আওয়ামী লীগের বেশ আগ্রহ ছিল। বিএনপিও চেষ্টা করেছে। আওয়ামী লীগকে সমর্থন করার ক্ষেত্রে জাপার যুক্তি যেটা ছিল সেটি হলো, আওয়ামী লীগ একটি উদারপন্থি ও বামঘেঁষা রাজনৈতিক দল। আর বিএনপি রক্ষণশীল ও মধ্যপন্থি রাজনৈতিক ধারার শক্তি। জাপাও রক্ষণশীল ও মধ্যপন্থি দল। এই রসায়ন বিবেচনায় জাপা যদি বিএনপির সঙ্গে যায় তাহলে জাপার নিজস্ব আলাদা রাজনীতি থাকে না, সেখানে বিএনপির রাজনীতির মধ্যে জাপা হজম হয়ে যাবে। আর আওয়ামী লীগের সঙ্গে যেহেতু জাপার রাজনৈতিক আদর্শগত পার্থক্য রয়েছে, সেক্ষেত্রে আওয়ামী লীগের সঙ্গে গেলে জাপার স্বতন্ত্র অবস্থান টিকিয়ে রাখা সম্ভব হবে। এছাড়া রাজনৈতিক কৌশলগত কারণে আমরা আওয়ামী লীগের সঙ্গে সখ্য গড়েছি। কিন্তু আমরা নিজেদের স্বতন্ত্র অবস্থানটা ধরে রাখতে না পারলে জাপার রাজনীতিকে রক্ষা করা সম্ভব হবে না।