গোলাম মোহাম্মদ কাদের

বাংলাদেশ প্রতিদিন ।  প্রকাশ : রবিবার, ২২ এপ্রিল

দেশের রাজনীতি আজ অনিশ্চিত গন্তব্যের পথে। সামনের জাতীয় নির্বাচনকে ঘিরে রাজনৈতিক অঙ্গনে প্রতিদিন অস্থিরতা বৃদ্ধি পাচ্ছে। এ অস্থিরতা নতুন নয়। বিগত বেশ কয়েক বছর ধরে বাংলাদেশের রাজনীতি সোজা পথে চলছে না। হিংসাত্মক আন্দোলন, রক্তপাত, খুন, ঘুম, অপহরণ পাল্লা দিয়ে এগিয়ে চলছে। রাজপথের আন্দোলন স্তিমিত হলেও রাজনৈতিক অস্থিরতা কাটছে না। অস্থিরতা, ব্যাহত তেমন দৃশ্যমান না হলেও ভিতরে ভিতরে অস্বস্তি ও শঙ্কা মানুষকে বিচলিত করছে।

রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণে বাংলাদেশে চলছে অর্থনৈতিক মন্দা, সামাজিক সমস্যাসমূহ মাথাচাড়া দিচ্ছে, ব্যক্তিগত জীবনে উত্কণ্ঠা নিয়ে সাধারণ জনগণ দিন অতিবাহিত করছে।

রাজনৈতিক অনিশ্চয়তার কারণে বেসরকারি বিনিয়োগ, দেশি বা বিদেশি কোনোটাই তেমন লক্ষ্য করা যাচ্ছে না। বেকার সমস্যা প্রবল আকার ধারণ করেছে। যথাযথ বিনিয়োগের অভাবে চাকরির সুযোগ সৃষ্টি হচ্ছে না। দেশের অর্ধেকের বেশি কর্মক্ষম উপযুক্ত ব্যক্তি চাকরির অভাবে চরম হতাশায় ভুগছে। হতাশ তরুণ-তরুণীরা মাদকের দিকে ঝুঁকছে। মাদকের রমরমা ব্যবসার সাফল্যের সঙ্গে সঙ্গে জাতির ভবিষ্যৎ অমাবস্যার গভীর কালো অন্ধকারের পথে ধাবিত হচ্ছে।

অসামাজিক, দুষ্কৃতকারী নানান কর্মকাণ্ড উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পাচ্ছে। খুন, ডাকাতি, ধর্ষণ, চুরি, ছিনতাই, চাঁদাবাজি, দখলবাজি, রাহাজানি, গুম ইত্যাদি ঘটনা নিত্যনৈমিত্তিক হয়ে উঠেছে। এগুলো দমনের নামে নিরীহ মানুষের ওপর নির্যাতন, ঘুষ গ্রহণ, মামলা, অপহরণ, এমনকি বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হচ্ছে বলে অভিযোগ উঠছে।

এসব কিছু ঘটছে রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী সংস্থা এবং জনস্বার্থ ও জননিরাপত্তা নিশ্চিতকারী প্রতিষ্ঠানসমূহের ওপর যথাযথ তদারকির অভাব হচ্ছে। দুর্নীতির বিস্তার ঘটছে। প্রতিষ্ঠানসমূহ অকার্যকর বা জনস্বার্থ রক্ষায় উদাসীন ও কোনো কোনো ক্ষেত্রে জনস্বার্থবিরোধী ভূমিকায় লিপ্ত হয়ে পড়ছে। কারণ সরকার স্বাভাবিক কর্তব্যের বাইরে রাজনীতি নিয়ন্ত্রণে তাদের ব্যবহারে অধিক গুরুত্ব দিতে বাধ্য হচ্ছেন।

এ পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশের অর্জন হিসেবে, ‘স্বল্প উন্নত দেশ’ থেকে ‘উন্নয়নশীল দেশে’ রূপান্তরের প্রথম ধাপ অতিক্রম বা ‘নিম্নআয়’ থেকে ‘নিম্নমধ্যম আয়ের দেশ’ হওয়ার কাহিনী সাধারণ মানুষের কাছে বিশেষ করে বেকার তরুণ-তরুণী ও তাদের পরিবারের সদস্যদের জন্য সুকান্তের কবিতার ভাষায় ‘ক্ষুধার রাজ্যে পৃথিবী-গদ্যময়’, ‘পূর্ণিমা-চাঁদ যেন ঝলসানো রুটি’ বলে প্রতীয়মান হচ্ছে, বললে অত্যুক্তি হয় না। ঘটনাদৃষ্টে মনে হচ্ছে, নির্বাচন যতই এগিয়ে আসছে রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা ততই বাড়ছে। সঙ্গে সঙ্গে রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক ও ব্যক্তিগত অস্থিরতার বৃদ্ধি ঘটছে।

রাজনৈতিক অনিশ্চয়তার কারণ নির্বাচন নিয়ে অনিশ্চয়তা। সরকার ও তার প্রধান প্রতিপক্ষ, নির্বাচন প্রশ্নে নিজ নিজ অবস্থানে অনড়। আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে কোনো মধ্যবর্তী স্থানে আসার ও শান্তিপূর্ণ পরিবেশে নির্বাচন হবে এমন সম্ভাবনা দেখা যাচ্ছে না। ফলে নির্বাচন পূর্ব, নির্বাচনের সময় ও নির্বাচন উত্তর পরিস্থিতি ক্রমান্বয়ে উত্তপ্ত অর্থাৎ সাংঘর্ষিক বা অশান্তিপূর্ণ হবে এ আশঙ্কার সৃষ্টি হয়েছে। কোন পর্যায়ে কখন কতটা হিংসাত্মক পরিস্থিতি সৃষ্টি হতে পারে সেটা আন্দাজ করা যাচ্ছে না। নির্বাচনে সরকারের প্রধান প্রতিপক্ষ শেষ পর্যন্ত অংশগ্রহণ করবে কিনা সেটাও অনুমান করা যাচ্ছে না। মানুষ এসব শঙ্কা থেকে অনিশ্চয়তা থেকে মুক্তি চায়। মানুষ এ অবস্থার পরিবর্তন চায়, মানুষ শান্তি চায়। এ পরিবর্তন দিতে পারবে জাতীয় পার্টি, যদি জনগণ সুযোগ দেয়।

দেশের দায়িত্ব গ্রহণের সময় জাতীয় পার্টির বর্তমান নেতা আলহাজ হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ জনগণের ইচ্ছাকে গুরুত্ব দিয়েছিলেন। দেশ পরিচালনায় জনগণকে প্রাধান্য দিয়েছিলেন। ক্ষমতা ত্যাগের সময় রাজনৈতিক দলের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা ও আপস-মীমাংসার মাধ্যমেই নিয়মতান্ত্রিকভাবে সেটা করার উদ্যোগ নিয়েছিলেন। ক্ষমতা গ্রহণে রক্তপাত করেননি, ক্ষমতা আঁকড়ে রাখার জন্য সহিংসতা করেননি।

সে কারণে বলা যায়, জাতীয় পার্টি শান্তির দল। এখনো জাতীয় পার্টি চায় আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে শান্তিপূর্ণ উপায়ে রাজনীতি এগিয়ে যাক। দেশ স্বস্তি ও সমৃদ্ধির পথে অগ্রসর হোক। জাতীয় পার্টির বর্তমান স্লোগান ‘শান্তির জন্য পরিবর্তন, পরিবর্তনের জন্য জাতীয় পার্টি।’ তবে অনেকের মনে একটা প্রশ্ন আসতেই পারে জাতীয় পার্টি কি দায়িত্ব পালনের ক্ষমতা পাবে বা ক্ষমতার কাছাকাছি থাকবে?

সব দল যদি নির্বাচনে অংশগ্রহণ করে, তবে ধারণা করি প্রধানত দুটি ধারায় বিভক্ত হবে জনগণ ও সে কারণে রাজনৈতিক দলসমূহ। একটি ধারা চাইবে বর্তমান সরকার আবার নির্বাচিত হোক, বর্তমান ধারাবাহিকতা বজায় থাকুক। অপর ধারাটি চাইবে বর্তমান সরকার পরিবর্তিত হোক নতুন সরকার নতুন আঙ্গিকে দেশকে পরিচালনা করুক।

বাংলাদেশে এখন প্রধানত তিনটি রাজনৈতিক দল, যাদের দেশ পরিচালনার অভিজ্ঞতা আছে ও সব নির্বাচনী এলাকায় প্রার্থী দেওয়ার মতো সংগঠন ও সমর্থক আছে। সেগুলো হলো, বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ, বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল ও জাতীয় পার্টি। বাকি দুটি দলের মধ্যে প্রতিযোগিতা যত হাড্ডাহাড্ডি হবে ততই নিয়ামক শক্তি হিসেবে জাতীয় পার্টির দাম বাড়বে। কারণ জাতীয় পার্টি যে ধারাকে বা জোটকে সমর্থন জানাবে তারাই সরকার গঠন করবে এ সম্ভাবনা খুব বেশি। অধিকাংশ জনগণ মনে করে জাতীয় পার্টি যে দিকে ভর দিবে সে পক্ষের পাল্লা ঝুঁকে পড়বে। অর্থাৎ এ পরিপ্রেক্ষিতে বলা যায়, জাতীয় পার্টি পরবর্তী যে কোনো জোট সরকারের অংশ হবে। ঠিক মতো দরকষাকষি করতে পারলে এ ধরনের জোট সরকারে জাতীয় পার্টি শক্তিশালী অবস্থানে থাকতে পারবে। সে কারণে আশা করা যায় ওই সরকারের নীতিনির্ধারণে ও তা বাস্তবায়নে জাতীয় পার্টি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালনে সক্ষম হতে পারে।

যদি সরকারের প্রধান প্রতিপক্ষ কোনো কারণে নির্বাচনে অংশগ্রহণ থেকে বিরত থাকে, সে ক্ষেত্রেও দুই ধারার জনগোষ্ঠী বর্তমান থাকবে, সরকারের পক্ষে ও বিপক্ষে। বিপক্ষ রাজনৈতিক জনগোষ্ঠীর আশ্রয়স্থল হিসেবে জাতীয় পার্টি রাজনৈতিক মঞ্চের ভূমিকা রাখতে পারবে। তখন যদি নির্বাচনে জনগণের স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণের পরিবেশ থাকে ও জনগণ অংশগ্রহণ করে, জাতীয় পার্টি সব কটি আসনে প্রার্থী দিয়ে সে সব মানুষের প্রত্যাশার প্রতিফলন ঘটাতে পারবে। দেশের বেশির ভাগ মানুষ সরকার পরিবর্তন কামনা করলে জাতীয় পার্টি সংসদে সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে সরকার গঠন করতে পারবে। এখানে একটা বিষয় উল্লেখ্য, দেশের সিংহভাগ মানুষ অংশগ্রহণ করলে নির্বাচন হবে অংশগ্রহণমূলক, কোনো কোনো দল নির্বাচনে অংশ না নিলেও। অর্থাৎ সে নির্বাচন ওই মাপকাঠিতে অগ্রহণযোগ্য বলা যাবে না।

জাতীয় পার্টি শুধু শান্তির দল নয়, বিগত দিনের ইতিহাস সাক্ষ্য দেয় জাতীয় পার্টির শাসন আমল ছিল সমৃদ্ধির, ছিল সুশাসনের। আইনের শাসন ছিল, মানুষের নিরাপত্তা নিশ্চিত ছিল। জাতীয় পার্টি দেশ পরিচালনার দায়িত্বের ভাগ নিতে পারলে বা সম্পূর্ণ দায়িত্ব নিলে দেশে শান্তি আসবে, সমৃদ্ধি আসবে, জনগণের নিরাপত্তা নিশ্চিত হবে। বর্ণিত পর্যালোচনার আলোকে বলা যায়, সে লক্ষ্য অর্জন কোনো কঠিন বিষয় নয়। বরং রাজনীতির গতি-প্রকৃতি বিবেচনায় অত্যন্ত স্বাভাবিক বলে প্রতীয়মান হচ্ছে।

লেখক : সাবেক মন্ত্রী ও কো-চেয়ারম্যান, জাতীয় পার্টি।